ভ্রান্তিবিলাস
বই : ভ্রান্তিবিলাস লেখক : জাকারিয়া মাসুদমুদ্রিত মূল্য : ২২৫ টাকাপ্রকাশনী : সন্দীপন প্রকাশনস্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন? ..যদি স্রষ্টা একজনই হন তবে, তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? আর যদি স্রষ্টা একটি মাত্র ধর্ম পাঠিয়ে থাকেন, তবে স্রষ্টার মনোনীত সেই ধর্ম কোনটি? হুমায়ুন আজাদ তার লিখনীর মাধ্যমে অল্পজ্ঞানী মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার কিছুটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—যদি স্রষ্টা একজনই হন, তবে তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? কেন একটি ধর্ম পাঠালেন না? তিনি বলেন, “বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন। তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতাম। তিনি তা করেন নি কেনো?” [হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ১৪৩] .তার এই অভিযোগের বিষয়ে আমাদের সরল কথা এটাই, স্রষ্টা পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি একটি মাত্র ধর্মই মানব জাতির জন্যে নির্বাচিত করেছেন। আর তা হলো—‘ইসলাম’। স্রষ্টার মনোনীত দ্বীনের মৌলিক বিষয়বস্তু যুগে যুগে একই ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। প্রশ্ন জাগতে পারে—মৌলিক বিষয় একই ছিলো, কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি কেন ভিন্ন ছিলো?এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজ তৈরি হতে অনেকটা সময় লেগেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের আসবাবপত্র, বাসস্থান, যানবাহনসহ বিশ্বের যত চমকপ্রদ পরিবর্তন, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। আদিম সমাজ এতটা উন্নত ছিলো না। সে সময়ে কেউ গুহায় বসবাস করেছে, কেউ কেউ গাছের পাতা পরিধান করেছে, কেউবা আগুনে ঝলসিয়ে মাংস ভক্ষণ করেছে। .এক এক নবীদের সময়ে এক এক শরীয়ার প্রকৃতি থাকার কারণ হলো, তাদের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতি। যে ধরণের হুকুম পালন করা সমসাময়িক মানুষদের জন্যে সহজসাধ্য ছিলো, সেটিই সে সময়ের শরীয়া হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এক এক নবীর শরীয়ার প্রকৃতি এক এক রকম ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল সময়ে জন্যে স্রষ্টার প্রণীত মৌলিক বিধান একই ছিলো। এই সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল : ৩৬ আয়াত].আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। সুতরাং আমার ইবাদত করো।” [সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫ আয়াত].আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেন, “তিনি (স্রষ্টা) তোমাদের জন্যে সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি। আর আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো—তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” [সূরা আশ-শুরা : ১৩ আয়াত].মহান স্রষ্টার এসব আয়াত আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, স্রষ্টার প্রণীত ধর্ম যুগে যুগে একই ছিলো। যে ধর্মের প্রধান আহ্বান ছিলো—তাগুতকে অস্বীকার করা, আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া। .এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ চেনানোর জন্যে নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এসব আসমানী গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ ও নবীর নাম আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। কোরআনে উল্লেখিত নবীদের নামগুলো হলো—আদম, ইদরিস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ঈসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারুন, ইউনুস, দাউদ, সুলাইমান, ইলইয়াস, ইলইয়াসা, যুলফিকল, যাকারিয়্যা, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)।আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবীদের ওপর অনেক আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। কোরআনে তিনটি কিতাবের কথা বার বার বলা হয়েছে। ১) তাওরাত, ২) যাবূর, ৩) ইনজীল। উক্ত কিতাবত্রয় আল্লাহ তাআলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে প্রেরণ করেছিলেন।.(এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা আসমানী কিতাব নাযিল করে থাকেন, তবে সেগুলোর যে-কোনো একটি অনুসরণ করলেই তো হিদায়াতের রাস্তা পাওয়া সম্ভব। আমাদের কেনো শুধুমাত্র কোরআন অনুসরণ করতে হবে? বিষয়টা আমরা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আমাদের কেবলমাত্র কোরআনকেই অনুসরণ করার কারণ প্রধানত ৩ টি।(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন।(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক আল-কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা।(৩) কোরআন সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে।.(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন : আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রবৃত্তি পূজারিরা তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে—আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত কিতাবকে বিকৃত, সংযোজন, বিয়োজন সাধন করেছে। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নিজেদের মতামত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এই সকল আসমানী কিতাবের বিশুদ্ধতা বজায় নেই। এগুলোতে আল্লাহ তাআলা ও মানুষের বানানো কথার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখান থেকে কোনটা সৃষ্টিকর্তার কথা আর কোনটি মানুষের কথা, তা আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিলো, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিলো।” [সূরা বাকারাহ : ৭৫ আয়াত].আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্যে এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা কারারাহ :৭৯ আয়াত] .মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা। অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সূরা আলি-ইমরান : ৭৮ আয়াত].তাদের বিকৃতির একটি নমুনা লক্ষ করুন : ইয়াহুদিরা দাবি করত যে, উটের গোশত হারাম। অথচ এই বিধানটি আল্লাহ তাআলা তাদের তাওরাতে প্রদান করেননি। আল্লাহ তাআলা এই সব মিথ্যাবাদীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব যেগুলো নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যতীত সমস্ত আহার্য বস্তুই বনী-ইসরায়ীলদের জন্যে হালাল ছিলো। তুমি বলে দাও, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তওরাত নিয়ে এসো এবং তা পাঠ করো।” [সূরা আলি-ইমরান : ৯৩ আয়াত].(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা : আল্লাহ তাআলা অন্য কোনো কিতাবকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে ওয়াদা করেননি। পূর্ববর্তী সময়ে যতগুলো আসমানী কিতাব এসেছিলো, মানুষ সবগুলোরই বিকৃতি সাধন করেছে। তাই এগুলো থেকে মানবজাতির হিদায়াতের পথ খোঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোরআন হলো এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বেলায় এই ওয়াদা প্রদান করেছেন যে, তিনি এই কিতাবকে সংরক্ষন করে রাখবেন। তিনি বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর : ৯ আয়াত] .এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নেওয়া প্রয়োজন—কেন আল্লাহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করলেন না? আসলে এর জবাব ওপরেই রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে। অন্যান্য কোনো ধর্মগ্রন্থই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে পাঠানো হয়নি। যখন সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রেরিত হয়েছে, তখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কী প্রয়োজনীয়তা আছে? আর যখন সে সময়ও গত হয়ে গেছে, এবং সে সকল কিতাব রহিতকারী কোরআন নাযিল হয়েছে, তখন সেগুলোর কীই-বা দরকার আছে?.(৩) সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে : আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত হয়নি; তবুও আমাদের জন্যে ওগুলো মানা ফরয নয়। কেননা পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলো ছিলো তৎকালীন সময়ের জন্যে, তৎকালীন জাতির জন্যে। যখন সেই সময় ও সেই জাতি বিলীন হয়ে গেছে, তখন আর ওইসব ধর্মগ্রন্থের কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? কোরআন কারীমের পূর্বে যে ধর্মগ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো, সেগুলোতে তৎকালীন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক বৈশিষ্টের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছে। আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছিলো। .কিন্তু আল কোরআন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে কোরআন পাঠানো হয়েছে, তাই এই কিতাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আর কোন নবীই তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের সর্বজনীনতা দাবি করেননি। বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া তার কিতাব বা ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যে আপনিও দেখবেন ইসলাম ছাড়া অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মই তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে না। বর্তমানকালে খৃষ্টানগণ তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে থাকে। অথচ তাদের তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাইবেলে যিশু বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অন্য কোনো গোত্রের জন্য নয়। (মথি : ১০/৬, ১৫/২২,২৪,২৫,২৬)।. তাই আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হবে—কোরআন এবং কোরআন যে দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, সে দ্বীন। আর কোরআন কেবলমাত্র একটি মাত্র দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; আর তা হলো ‘ইসলাম’। কোরআন বলছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ০৩ আয়াত].আজাদ তার বইতে এ কথাও বলেছেন যে, প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে। আর মক্কার প্রচলিত ধর্ম থেকেই না কি ক্রমান্বয়ে ইসলাম বিকশিত হয়! । তিনি বলেন, “তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে...মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম।” [আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ৯৬].আমরা আমাদের আলোচনার দ্বারা বুঝিয়েছি যে, ইসলাম কখনওই নিজেকে নতুন বলে দাবি করেনি। বরং ইসলাম বার বার উল্লেখ করেছে, এই দ্বীন পূর্ববর্তী নবীগণেরই দ্বীন। তাঁরা যে দ্বীন প্রচার করেছেন, সেই দ্বীন। তারা যে কথার দাওয়াত দিয়েছেন, ইসলামও ঠিক একই কথার দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ (স.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। [সূরা আন নাহল : ১২৩ আয়াত].ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আর মুসলিম বলা হয় যারা ইসলামকে মেনে চলে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার সামনে যে সমর্পণ করে, সে-ই হলো মুসলিম। [ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃষ্ঠা : ২৪]
An Najahah Shop
Category List
All products

বই : ভ্রান্তিবিলাস
লেখক : জাকারিয়া মাসুদ
মুদ্রিত মূল্য : ২২৫ টাকা
প্রকাশনী : সন্দীপন প্রকাশন
স্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন?
.
.
যদি স্রষ্টা একজনই হন তবে, তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? আর যদি স্রষ্টা একটি মাত্র ধর্ম পাঠিয়ে থাকেন, তবে স্রষ্টার মনোনীত সেই ধর্ম কোনটি?
হুমায়ুন আজাদ তার লিখনীর মাধ্যমে অল্পজ্ঞানী মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার কিছুটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—যদি স্রষ্টা একজনই হন, তবে তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? কেন একটি ধর্ম পাঠালেন না? তিনি বলেন, “বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন। তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতাম। তিনি তা করেন নি কেনো?” [হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ১৪৩]
.
তার এই অভিযোগের বিষয়ে আমাদের সরল কথা এটাই, স্রষ্টা পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি একটি মাত্র ধর্মই মানব জাতির জন্যে নির্বাচিত করেছেন। আর তা হলো—‘ইসলাম’। স্রষ্টার মনোনীত দ্বীনের মৌলিক বিষয়বস্তু যুগে যুগে একই ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। প্রশ্ন জাগতে পারে—মৌলিক বিষয় একই ছিলো, কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি কেন ভিন্ন ছিলো?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজ তৈরি হতে অনেকটা সময় লেগেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের আসবাবপত্র, বাসস্থান, যানবাহনসহ বিশ্বের যত চমকপ্রদ পরিবর্তন, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। আদিম সমাজ এতটা উন্নত ছিলো না। সে সময়ে কেউ গুহায় বসবাস করেছে, কেউ কেউ গাছের পাতা পরিধান করেছে, কেউবা আগুনে ঝলসিয়ে মাংস ভক্ষণ করেছে।
.
এক এক নবীদের সময়ে এক এক শরীয়ার প্রকৃতি থাকার কারণ হলো, তাদের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতি। যে ধরণের হুকুম পালন করা সমসাময়িক মানুষদের জন্যে সহজসাধ্য ছিলো, সেটিই সে সময়ের শরীয়া হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এক এক নবীর শরীয়ার প্রকৃতি এক এক রকম ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল সময়ে জন্যে স্রষ্টার প্রণীত মৌলিক বিধান একই ছিলো। এই সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল : ৩৬ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। সুতরাং আমার ইবাদত করো।” [সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেন, “তিনি (স্রষ্টা) তোমাদের জন্যে সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি। আর আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো—তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” [সূরা আশ-শুরা : ১৩ আয়াত]
.
মহান স্রষ্টার এসব আয়াত আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, স্রষ্টার প্রণীত ধর্ম যুগে যুগে একই ছিলো। যে ধর্মের প্রধান আহ্বান ছিলো—তাগুতকে অস্বীকার করা, আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।
.
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ চেনানোর জন্যে নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এসব আসমানী গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ ও নবীর নাম আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। কোরআনে উল্লেখিত নবীদের নামগুলো হলো—আদম, ইদরিস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ঈসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারুন, ইউনুস, দাউদ, সুলাইমান, ইলইয়াস, ইলইয়াসা, যুলফিকল, যাকারিয়্যা, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবীদের ওপর অনেক আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। কোরআনে তিনটি কিতাবের কথা বার বার বলা হয়েছে। ১) তাওরাত, ২) যাবূর, ৩) ইনজীল। উক্ত কিতাবত্রয় আল্লাহ তাআলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে প্রেরণ করেছিলেন।
.
(
এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা আসমানী কিতাব নাযিল করে থাকেন, তবে সেগুলোর যে-কোনো একটি অনুসরণ করলেই তো হিদায়াতের রাস্তা পাওয়া সম্ভব। আমাদের কেনো শুধুমাত্র কোরআন অনুসরণ করতে হবে? বিষয়টা আমরা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আমাদের কেবলমাত্র কোরআনকেই অনুসরণ করার কারণ প্রধানত ৩ টি।
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন।
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক আল-কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা।
(৩) কোরআন সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে।
.
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন :
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রবৃত্তি পূজারিরা তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে—আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত কিতাবকে বিকৃত, সংযোজন, বিয়োজন সাধন করেছে। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নিজেদের মতামত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এই সকল আসমানী কিতাবের বিশুদ্ধতা বজায় নেই। এগুলোতে আল্লাহ তাআলা ও মানুষের বানানো কথার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখান থেকে কোনটা সৃষ্টিকর্তার কথা আর কোনটি মানুষের কথা, তা আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিলো, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিলো।” [সূরা বাকারাহ : ৭৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্যে এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা কারারাহ :৭৯ আয়াত]
.
মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা। অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সূরা আলি-ইমরান : ৭৮ আয়াত]
.
তাদের বিকৃতির একটি নমুনা লক্ষ করুন : ইয়াহুদিরা দাবি করত যে, উটের গোশত হারাম। অথচ এই বিধানটি আল্লাহ তাআলা তাদের তাওরাতে প্রদান করেননি। আল্লাহ তাআলা এই সব মিথ্যাবাদীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব যেগুলো নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যতীত সমস্ত আহার্য বস্তুই বনী-ইসরায়ীলদের জন্যে হালাল ছিলো। তুমি বলে দাও, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তওরাত নিয়ে এসো এবং তা পাঠ করো।” [সূরা আলি-ইমরান : ৯৩ আয়াত]
.
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা :
আল্লাহ তাআলা অন্য কোনো কিতাবকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে ওয়াদা করেননি। পূর্ববর্তী সময়ে যতগুলো আসমানী কিতাব এসেছিলো, মানুষ সবগুলোরই বিকৃতি সাধন করেছে। তাই এগুলো থেকে মানবজাতির হিদায়াতের পথ খোঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোরআন হলো এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বেলায় এই ওয়াদা প্রদান করেছেন যে, তিনি এই কিতাবকে সংরক্ষন করে রাখবেন। তিনি বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর : ৯ আয়াত]
.
এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নেওয়া প্রয়োজন—কেন আল্লাহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করলেন না? আসলে এর জবাব ওপরেই রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে। অন্যান্য কোনো ধর্মগ্রন্থই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে পাঠানো হয়নি। যখন সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রেরিত হয়েছে, তখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কী প্রয়োজনীয়তা আছে? আর যখন সে সময়ও গত হয়ে গেছে, এবং সে সকল কিতাব রহিতকারী কোরআন নাযিল হয়েছে, তখন সেগুলোর কীই-বা দরকার আছে?
.
(৩) সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে :
আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত হয়নি; তবুও আমাদের জন্যে ওগুলো মানা ফরয নয়। কেননা পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলো ছিলো তৎকালীন সময়ের জন্যে, তৎকালীন জাতির জন্যে। যখন সেই সময় ও সেই জাতি বিলীন হয়ে গেছে, তখন আর ওইসব ধর্মগ্রন্থের কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? কোরআন কারীমের পূর্বে যে ধর্মগ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো, সেগুলোতে তৎকালীন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক বৈশিষ্টের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছে। আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছিলো।
.
কিন্তু আল কোরআন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে কোরআন পাঠানো হয়েছে, তাই এই কিতাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আর কোন নবীই তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের সর্বজনীনতা দাবি করেননি। বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া তার কিতাব বা ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যে আপনিও দেখবেন ইসলাম ছাড়া অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মই তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে না। বর্তমানকালে খৃষ্টানগণ তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে থাকে। অথচ তাদের তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাইবেলে যিশু বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অন্য কোনো গোত্রের জন্য নয়। (মথি : ১০/৬, ১৫/২২,২৪,২৫,২৬)।
.
তাই আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হবে—কোরআন এবং কোরআন যে দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, সে দ্বীন। আর কোরআন কেবলমাত্র একটি মাত্র দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; আর তা হলো ‘ইসলাম’। কোরআন বলছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ০৩ আয়াত]
.
আজাদ তার বইতে এ কথাও বলেছেন যে, প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে। আর মক্কার প্রচলিত ধর্ম থেকেই না কি ক্রমান্বয়ে ইসলাম বিকশিত হয়! । তিনি বলেন, “তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে...মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম।” [আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ৯৬]
.
আমরা আমাদের আলোচনার দ্বারা বুঝিয়েছি যে, ইসলাম কখনওই নিজেকে নতুন বলে দাবি করেনি। বরং ইসলাম বার বার উল্লেখ করেছে, এই দ্বীন পূর্ববর্তী নবীগণেরই দ্বীন। তাঁরা যে দ্বীন প্রচার করেছেন, সেই দ্বীন। তারা যে কথার দাওয়াত দিয়েছেন, ইসলামও ঠিক একই কথার দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ (স.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। [সূরা আন নাহল : ১২৩ আয়াত]
.
ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আর মুসলিম বলা হয় যারা ইসলামকে মেনে চলে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার সামনে যে সমর্পণ করে, সে-ই হলো মুসলিম। [ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃষ্ঠা : ২৪]
লেখক : জাকারিয়া মাসুদ
মুদ্রিত মূল্য : ২২৫ টাকা
প্রকাশনী : সন্দীপন প্রকাশন
স্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন?
.
.
যদি স্রষ্টা একজনই হন তবে, তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? আর যদি স্রষ্টা একটি মাত্র ধর্ম পাঠিয়ে থাকেন, তবে স্রষ্টার মনোনীত সেই ধর্ম কোনটি?
হুমায়ুন আজাদ তার লিখনীর মাধ্যমে অল্পজ্ঞানী মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার কিছুটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—যদি স্রষ্টা একজনই হন, তবে তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? কেন একটি ধর্ম পাঠালেন না? তিনি বলেন, “বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন। তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতাম। তিনি তা করেন নি কেনো?” [হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ১৪৩]
.
তার এই অভিযোগের বিষয়ে আমাদের সরল কথা এটাই, স্রষ্টা পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি একটি মাত্র ধর্মই মানব জাতির জন্যে নির্বাচিত করেছেন। আর তা হলো—‘ইসলাম’। স্রষ্টার মনোনীত দ্বীনের মৌলিক বিষয়বস্তু যুগে যুগে একই ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। প্রশ্ন জাগতে পারে—মৌলিক বিষয় একই ছিলো, কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি কেন ভিন্ন ছিলো?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজ তৈরি হতে অনেকটা সময় লেগেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের আসবাবপত্র, বাসস্থান, যানবাহনসহ বিশ্বের যত চমকপ্রদ পরিবর্তন, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। আদিম সমাজ এতটা উন্নত ছিলো না। সে সময়ে কেউ গুহায় বসবাস করেছে, কেউ কেউ গাছের পাতা পরিধান করেছে, কেউবা আগুনে ঝলসিয়ে মাংস ভক্ষণ করেছে।
.
এক এক নবীদের সময়ে এক এক শরীয়ার প্রকৃতি থাকার কারণ হলো, তাদের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতি। যে ধরণের হুকুম পালন করা সমসাময়িক মানুষদের জন্যে সহজসাধ্য ছিলো, সেটিই সে সময়ের শরীয়া হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এক এক নবীর শরীয়ার প্রকৃতি এক এক রকম ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল সময়ে জন্যে স্রষ্টার প্রণীত মৌলিক বিধান একই ছিলো। এই সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল : ৩৬ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। সুতরাং আমার ইবাদত করো।” [সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেন, “তিনি (স্রষ্টা) তোমাদের জন্যে সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি। আর আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো—তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” [সূরা আশ-শুরা : ১৩ আয়াত]
.
মহান স্রষ্টার এসব আয়াত আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, স্রষ্টার প্রণীত ধর্ম যুগে যুগে একই ছিলো। যে ধর্মের প্রধান আহ্বান ছিলো—তাগুতকে অস্বীকার করা, আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।
.
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ চেনানোর জন্যে নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এসব আসমানী গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ ও নবীর নাম আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। কোরআনে উল্লেখিত নবীদের নামগুলো হলো—আদম, ইদরিস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ঈসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারুন, ইউনুস, দাউদ, সুলাইমান, ইলইয়াস, ইলইয়াসা, যুলফিকল, যাকারিয়্যা, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবীদের ওপর অনেক আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। কোরআনে তিনটি কিতাবের কথা বার বার বলা হয়েছে। ১) তাওরাত, ২) যাবূর, ৩) ইনজীল। উক্ত কিতাবত্রয় আল্লাহ তাআলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে প্রেরণ করেছিলেন।
.
(
এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা আসমানী কিতাব নাযিল করে থাকেন, তবে সেগুলোর যে-কোনো একটি অনুসরণ করলেই তো হিদায়াতের রাস্তা পাওয়া সম্ভব। আমাদের কেনো শুধুমাত্র কোরআন অনুসরণ করতে হবে? বিষয়টা আমরা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আমাদের কেবলমাত্র কোরআনকেই অনুসরণ করার কারণ প্রধানত ৩ টি।
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন।
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক আল-কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা।
(৩) কোরআন সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে।
.
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন :
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রবৃত্তি পূজারিরা তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে—আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত কিতাবকে বিকৃত, সংযোজন, বিয়োজন সাধন করেছে। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নিজেদের মতামত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এই সকল আসমানী কিতাবের বিশুদ্ধতা বজায় নেই। এগুলোতে আল্লাহ তাআলা ও মানুষের বানানো কথার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখান থেকে কোনটা সৃষ্টিকর্তার কথা আর কোনটি মানুষের কথা, তা আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিলো, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিলো।” [সূরা বাকারাহ : ৭৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্যে এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা কারারাহ :৭৯ আয়াত]
.
মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা। অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সূরা আলি-ইমরান : ৭৮ আয়াত]
.
তাদের বিকৃতির একটি নমুনা লক্ষ করুন : ইয়াহুদিরা দাবি করত যে, উটের গোশত হারাম। অথচ এই বিধানটি আল্লাহ তাআলা তাদের তাওরাতে প্রদান করেননি। আল্লাহ তাআলা এই সব মিথ্যাবাদীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব যেগুলো নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যতীত সমস্ত আহার্য বস্তুই বনী-ইসরায়ীলদের জন্যে হালাল ছিলো। তুমি বলে দাও, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তওরাত নিয়ে এসো এবং তা পাঠ করো।” [সূরা আলি-ইমরান : ৯৩ আয়াত]
.
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা :
আল্লাহ তাআলা অন্য কোনো কিতাবকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে ওয়াদা করেননি। পূর্ববর্তী সময়ে যতগুলো আসমানী কিতাব এসেছিলো, মানুষ সবগুলোরই বিকৃতি সাধন করেছে। তাই এগুলো থেকে মানবজাতির হিদায়াতের পথ খোঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোরআন হলো এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বেলায় এই ওয়াদা প্রদান করেছেন যে, তিনি এই কিতাবকে সংরক্ষন করে রাখবেন। তিনি বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর : ৯ আয়াত]
.
এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নেওয়া প্রয়োজন—কেন আল্লাহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করলেন না? আসলে এর জবাব ওপরেই রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে। অন্যান্য কোনো ধর্মগ্রন্থই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে পাঠানো হয়নি। যখন সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রেরিত হয়েছে, তখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কী প্রয়োজনীয়তা আছে? আর যখন সে সময়ও গত হয়ে গেছে, এবং সে সকল কিতাব রহিতকারী কোরআন নাযিল হয়েছে, তখন সেগুলোর কীই-বা দরকার আছে?
.
(৩) সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে :
আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত হয়নি; তবুও আমাদের জন্যে ওগুলো মানা ফরয নয়। কেননা পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলো ছিলো তৎকালীন সময়ের জন্যে, তৎকালীন জাতির জন্যে। যখন সেই সময় ও সেই জাতি বিলীন হয়ে গেছে, তখন আর ওইসব ধর্মগ্রন্থের কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? কোরআন কারীমের পূর্বে যে ধর্মগ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো, সেগুলোতে তৎকালীন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক বৈশিষ্টের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছে। আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছিলো।
.
কিন্তু আল কোরআন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে কোরআন পাঠানো হয়েছে, তাই এই কিতাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আর কোন নবীই তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের সর্বজনীনতা দাবি করেননি। বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া তার কিতাব বা ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যে আপনিও দেখবেন ইসলাম ছাড়া অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মই তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে না। বর্তমানকালে খৃষ্টানগণ তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে থাকে। অথচ তাদের তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাইবেলে যিশু বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অন্য কোনো গোত্রের জন্য নয়। (মথি : ১০/৬, ১৫/২২,২৪,২৫,২৬)।
.
তাই আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হবে—কোরআন এবং কোরআন যে দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, সে দ্বীন। আর কোরআন কেবলমাত্র একটি মাত্র দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; আর তা হলো ‘ইসলাম’। কোরআন বলছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ০৩ আয়াত]
.
আজাদ তার বইতে এ কথাও বলেছেন যে, প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে। আর মক্কার প্রচলিত ধর্ম থেকেই না কি ক্রমান্বয়ে ইসলাম বিকশিত হয়! । তিনি বলেন, “তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে...মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম।” [আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ৯৬]
.
আমরা আমাদের আলোচনার দ্বারা বুঝিয়েছি যে, ইসলাম কখনওই নিজেকে নতুন বলে দাবি করেনি। বরং ইসলাম বার বার উল্লেখ করেছে, এই দ্বীন পূর্ববর্তী নবীগণেরই দ্বীন। তাঁরা যে দ্বীন প্রচার করেছেন, সেই দ্বীন। তারা যে কথার দাওয়াত দিয়েছেন, ইসলামও ঠিক একই কথার দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ (স.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। [সূরা আন নাহল : ১২৩ আয়াত]
.
ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আর মুসলিম বলা হয় যারা ইসলামকে মেনে চলে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার সামনে যে সমর্পণ করে, সে-ই হলো মুসলিম। [ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃষ্ঠা : ২৪]
ভ্রান্তিবিলাস
165 BDT225 BDTSave 60 BDT
1
বই : ভ্রান্তিবিলাস
লেখক : জাকারিয়া মাসুদ
মুদ্রিত মূল্য : ২২৫ টাকা
প্রকাশনী : সন্দীপন প্রকাশন
স্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন?
.
.
যদি স্রষ্টা একজনই হন তবে, তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? আর যদি স্রষ্টা একটি মাত্র ধর্ম পাঠিয়ে থাকেন, তবে স্রষ্টার মনোনীত সেই ধর্ম কোনটি?
হুমায়ুন আজাদ তার লিখনীর মাধ্যমে অল্পজ্ঞানী মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার কিছুটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—যদি স্রষ্টা একজনই হন, তবে তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? কেন একটি ধর্ম পাঠালেন না? তিনি বলেন, “বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন। তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতাম। তিনি তা করেন নি কেনো?” [হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ১৪৩]
.
তার এই অভিযোগের বিষয়ে আমাদের সরল কথা এটাই, স্রষ্টা পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি একটি মাত্র ধর্মই মানব জাতির জন্যে নির্বাচিত করেছেন। আর তা হলো—‘ইসলাম’। স্রষ্টার মনোনীত দ্বীনের মৌলিক বিষয়বস্তু যুগে যুগে একই ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। প্রশ্ন জাগতে পারে—মৌলিক বিষয় একই ছিলো, কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি কেন ভিন্ন ছিলো?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজ তৈরি হতে অনেকটা সময় লেগেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের আসবাবপত্র, বাসস্থান, যানবাহনসহ বিশ্বের যত চমকপ্রদ পরিবর্তন, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। আদিম সমাজ এতটা উন্নত ছিলো না। সে সময়ে কেউ গুহায় বসবাস করেছে, কেউ কেউ গাছের পাতা পরিধান করেছে, কেউবা আগুনে ঝলসিয়ে মাংস ভক্ষণ করেছে।
.
এক এক নবীদের সময়ে এক এক শরীয়ার প্রকৃতি থাকার কারণ হলো, তাদের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতি। যে ধরণের হুকুম পালন করা সমসাময়িক মানুষদের জন্যে সহজসাধ্য ছিলো, সেটিই সে সময়ের শরীয়া হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এক এক নবীর শরীয়ার প্রকৃতি এক এক রকম ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল সময়ে জন্যে স্রষ্টার প্রণীত মৌলিক বিধান একই ছিলো। এই সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল : ৩৬ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। সুতরাং আমার ইবাদত করো।” [সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেন, “তিনি (স্রষ্টা) তোমাদের জন্যে সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি। আর আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো—তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” [সূরা আশ-শুরা : ১৩ আয়াত]
.
মহান স্রষ্টার এসব আয়াত আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, স্রষ্টার প্রণীত ধর্ম যুগে যুগে একই ছিলো। যে ধর্মের প্রধান আহ্বান ছিলো—তাগুতকে অস্বীকার করা, আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।
.
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ চেনানোর জন্যে নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এসব আসমানী গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ ও নবীর নাম আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। কোরআনে উল্লেখিত নবীদের নামগুলো হলো—আদম, ইদরিস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ঈসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারুন, ইউনুস, দাউদ, সুলাইমান, ইলইয়াস, ইলইয়াসা, যুলফিকল, যাকারিয়্যা, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবীদের ওপর অনেক আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। কোরআনে তিনটি কিতাবের কথা বার বার বলা হয়েছে। ১) তাওরাত, ২) যাবূর, ৩) ইনজীল। উক্ত কিতাবত্রয় আল্লাহ তাআলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে প্রেরণ করেছিলেন।
.
(
এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা আসমানী কিতাব নাযিল করে থাকেন, তবে সেগুলোর যে-কোনো একটি অনুসরণ করলেই তো হিদায়াতের রাস্তা পাওয়া সম্ভব। আমাদের কেনো শুধুমাত্র কোরআন অনুসরণ করতে হবে? বিষয়টা আমরা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আমাদের কেবলমাত্র কোরআনকেই অনুসরণ করার কারণ প্রধানত ৩ টি।
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন।
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক আল-কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা।
(৩) কোরআন সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে।
.
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন :
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রবৃত্তি পূজারিরা তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে—আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত কিতাবকে বিকৃত, সংযোজন, বিয়োজন সাধন করেছে। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নিজেদের মতামত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এই সকল আসমানী কিতাবের বিশুদ্ধতা বজায় নেই। এগুলোতে আল্লাহ তাআলা ও মানুষের বানানো কথার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখান থেকে কোনটা সৃষ্টিকর্তার কথা আর কোনটি মানুষের কথা, তা আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিলো, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিলো।” [সূরা বাকারাহ : ৭৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্যে এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা কারারাহ :৭৯ আয়াত]
.
মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা। অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সূরা আলি-ইমরান : ৭৮ আয়াত]
.
তাদের বিকৃতির একটি নমুনা লক্ষ করুন : ইয়াহুদিরা দাবি করত যে, উটের গোশত হারাম। অথচ এই বিধানটি আল্লাহ তাআলা তাদের তাওরাতে প্রদান করেননি। আল্লাহ তাআলা এই সব মিথ্যাবাদীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব যেগুলো নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যতীত সমস্ত আহার্য বস্তুই বনী-ইসরায়ীলদের জন্যে হালাল ছিলো। তুমি বলে দাও, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তওরাত নিয়ে এসো এবং তা পাঠ করো।” [সূরা আলি-ইমরান : ৯৩ আয়াত]
.
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা :
আল্লাহ তাআলা অন্য কোনো কিতাবকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে ওয়াদা করেননি। পূর্ববর্তী সময়ে যতগুলো আসমানী কিতাব এসেছিলো, মানুষ সবগুলোরই বিকৃতি সাধন করেছে। তাই এগুলো থেকে মানবজাতির হিদায়াতের পথ খোঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোরআন হলো এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বেলায় এই ওয়াদা প্রদান করেছেন যে, তিনি এই কিতাবকে সংরক্ষন করে রাখবেন। তিনি বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর : ৯ আয়াত]
.
এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নেওয়া প্রয়োজন—কেন আল্লাহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করলেন না? আসলে এর জবাব ওপরেই রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে। অন্যান্য কোনো ধর্মগ্রন্থই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে পাঠানো হয়নি। যখন সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রেরিত হয়েছে, তখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কী প্রয়োজনীয়তা আছে? আর যখন সে সময়ও গত হয়ে গেছে, এবং সে সকল কিতাব রহিতকারী কোরআন নাযিল হয়েছে, তখন সেগুলোর কীই-বা দরকার আছে?
.
(৩) সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে :
আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত হয়নি; তবুও আমাদের জন্যে ওগুলো মানা ফরয নয়। কেননা পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলো ছিলো তৎকালীন সময়ের জন্যে, তৎকালীন জাতির জন্যে। যখন সেই সময় ও সেই জাতি বিলীন হয়ে গেছে, তখন আর ওইসব ধর্মগ্রন্থের কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? কোরআন কারীমের পূর্বে যে ধর্মগ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো, সেগুলোতে তৎকালীন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক বৈশিষ্টের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছে। আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছিলো।
.
কিন্তু আল কোরআন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে কোরআন পাঠানো হয়েছে, তাই এই কিতাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আর কোন নবীই তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের সর্বজনীনতা দাবি করেননি। বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া তার কিতাব বা ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যে আপনিও দেখবেন ইসলাম ছাড়া অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মই তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে না। বর্তমানকালে খৃষ্টানগণ তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে থাকে। অথচ তাদের তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাইবেলে যিশু বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অন্য কোনো গোত্রের জন্য নয়। (মথি : ১০/৬, ১৫/২২,২৪,২৫,২৬)।
.
তাই আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হবে—কোরআন এবং কোরআন যে দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, সে দ্বীন। আর কোরআন কেবলমাত্র একটি মাত্র দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; আর তা হলো ‘ইসলাম’। কোরআন বলছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ০৩ আয়াত]
.
আজাদ তার বইতে এ কথাও বলেছেন যে, প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে। আর মক্কার প্রচলিত ধর্ম থেকেই না কি ক্রমান্বয়ে ইসলাম বিকশিত হয়! । তিনি বলেন, “তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে...মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম।” [আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ৯৬]
.
আমরা আমাদের আলোচনার দ্বারা বুঝিয়েছি যে, ইসলাম কখনওই নিজেকে নতুন বলে দাবি করেনি। বরং ইসলাম বার বার উল্লেখ করেছে, এই দ্বীন পূর্ববর্তী নবীগণেরই দ্বীন। তাঁরা যে দ্বীন প্রচার করেছেন, সেই দ্বীন। তারা যে কথার দাওয়াত দিয়েছেন, ইসলামও ঠিক একই কথার দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ (স.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। [সূরা আন নাহল : ১২৩ আয়াত]
.
ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আর মুসলিম বলা হয় যারা ইসলামকে মেনে চলে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার সামনে যে সমর্পণ করে, সে-ই হলো মুসলিম। [ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃষ্ঠা : ২৪]
লেখক : জাকারিয়া মাসুদ
মুদ্রিত মূল্য : ২২৫ টাকা
প্রকাশনী : সন্দীপন প্রকাশন
স্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন?
.
.
যদি স্রষ্টা একজনই হন তবে, তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? আর যদি স্রষ্টা একটি মাত্র ধর্ম পাঠিয়ে থাকেন, তবে স্রষ্টার মনোনীত সেই ধর্ম কোনটি?
হুমায়ুন আজাদ তার লিখনীর মাধ্যমে অল্পজ্ঞানী মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার কিছুটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—যদি স্রষ্টা একজনই হন, তবে তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? কেন একটি ধর্ম পাঠালেন না? তিনি বলেন, “বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন। তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতাম। তিনি তা করেন নি কেনো?” [হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ১৪৩]
.
তার এই অভিযোগের বিষয়ে আমাদের সরল কথা এটাই, স্রষ্টা পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি একটি মাত্র ধর্মই মানব জাতির জন্যে নির্বাচিত করেছেন। আর তা হলো—‘ইসলাম’। স্রষ্টার মনোনীত দ্বীনের মৌলিক বিষয়বস্তু যুগে যুগে একই ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। প্রশ্ন জাগতে পারে—মৌলিক বিষয় একই ছিলো, কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি কেন ভিন্ন ছিলো?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজ তৈরি হতে অনেকটা সময় লেগেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের আসবাবপত্র, বাসস্থান, যানবাহনসহ বিশ্বের যত চমকপ্রদ পরিবর্তন, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। আদিম সমাজ এতটা উন্নত ছিলো না। সে সময়ে কেউ গুহায় বসবাস করেছে, কেউ কেউ গাছের পাতা পরিধান করেছে, কেউবা আগুনে ঝলসিয়ে মাংস ভক্ষণ করেছে।
.
এক এক নবীদের সময়ে এক এক শরীয়ার প্রকৃতি থাকার কারণ হলো, তাদের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতি। যে ধরণের হুকুম পালন করা সমসাময়িক মানুষদের জন্যে সহজসাধ্য ছিলো, সেটিই সে সময়ের শরীয়া হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এক এক নবীর শরীয়ার প্রকৃতি এক এক রকম ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল সময়ে জন্যে স্রষ্টার প্রণীত মৌলিক বিধান একই ছিলো। এই সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল : ৩৬ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। সুতরাং আমার ইবাদত করো।” [সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেন, “তিনি (স্রষ্টা) তোমাদের জন্যে সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি। আর আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো—তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” [সূরা আশ-শুরা : ১৩ আয়াত]
.
মহান স্রষ্টার এসব আয়াত আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, স্রষ্টার প্রণীত ধর্ম যুগে যুগে একই ছিলো। যে ধর্মের প্রধান আহ্বান ছিলো—তাগুতকে অস্বীকার করা, আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।
.
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ চেনানোর জন্যে নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এসব আসমানী গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ ও নবীর নাম আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। কোরআনে উল্লেখিত নবীদের নামগুলো হলো—আদম, ইদরিস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ঈসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারুন, ইউনুস, দাউদ, সুলাইমান, ইলইয়াস, ইলইয়াসা, যুলফিকল, যাকারিয়্যা, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবীদের ওপর অনেক আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। কোরআনে তিনটি কিতাবের কথা বার বার বলা হয়েছে। ১) তাওরাত, ২) যাবূর, ৩) ইনজীল। উক্ত কিতাবত্রয় আল্লাহ তাআলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে প্রেরণ করেছিলেন।
.
(
এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা আসমানী কিতাব নাযিল করে থাকেন, তবে সেগুলোর যে-কোনো একটি অনুসরণ করলেই তো হিদায়াতের রাস্তা পাওয়া সম্ভব। আমাদের কেনো শুধুমাত্র কোরআন অনুসরণ করতে হবে? বিষয়টা আমরা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আমাদের কেবলমাত্র কোরআনকেই অনুসরণ করার কারণ প্রধানত ৩ টি।
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন।
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক আল-কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা।
(৩) কোরআন সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে।
.
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন :
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রবৃত্তি পূজারিরা তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে—আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত কিতাবকে বিকৃত, সংযোজন, বিয়োজন সাধন করেছে। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নিজেদের মতামত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এই সকল আসমানী কিতাবের বিশুদ্ধতা বজায় নেই। এগুলোতে আল্লাহ তাআলা ও মানুষের বানানো কথার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখান থেকে কোনটা সৃষ্টিকর্তার কথা আর কোনটি মানুষের কথা, তা আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিলো, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিলো।” [সূরা বাকারাহ : ৭৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্যে এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা কারারাহ :৭৯ আয়াত]
.
মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা। অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সূরা আলি-ইমরান : ৭৮ আয়াত]
.
তাদের বিকৃতির একটি নমুনা লক্ষ করুন : ইয়াহুদিরা দাবি করত যে, উটের গোশত হারাম। অথচ এই বিধানটি আল্লাহ তাআলা তাদের তাওরাতে প্রদান করেননি। আল্লাহ তাআলা এই সব মিথ্যাবাদীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব যেগুলো নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যতীত সমস্ত আহার্য বস্তুই বনী-ইসরায়ীলদের জন্যে হালাল ছিলো। তুমি বলে দাও, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তওরাত নিয়ে এসো এবং তা পাঠ করো।” [সূরা আলি-ইমরান : ৯৩ আয়াত]
.
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা :
আল্লাহ তাআলা অন্য কোনো কিতাবকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে ওয়াদা করেননি। পূর্ববর্তী সময়ে যতগুলো আসমানী কিতাব এসেছিলো, মানুষ সবগুলোরই বিকৃতি সাধন করেছে। তাই এগুলো থেকে মানবজাতির হিদায়াতের পথ খোঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোরআন হলো এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বেলায় এই ওয়াদা প্রদান করেছেন যে, তিনি এই কিতাবকে সংরক্ষন করে রাখবেন। তিনি বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর : ৯ আয়াত]
.
এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নেওয়া প্রয়োজন—কেন আল্লাহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করলেন না? আসলে এর জবাব ওপরেই রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে। অন্যান্য কোনো ধর্মগ্রন্থই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে পাঠানো হয়নি। যখন সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রেরিত হয়েছে, তখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কী প্রয়োজনীয়তা আছে? আর যখন সে সময়ও গত হয়ে গেছে, এবং সে সকল কিতাব রহিতকারী কোরআন নাযিল হয়েছে, তখন সেগুলোর কীই-বা দরকার আছে?
.
(৩) সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে :
আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত হয়নি; তবুও আমাদের জন্যে ওগুলো মানা ফরয নয়। কেননা পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলো ছিলো তৎকালীন সময়ের জন্যে, তৎকালীন জাতির জন্যে। যখন সেই সময় ও সেই জাতি বিলীন হয়ে গেছে, তখন আর ওইসব ধর্মগ্রন্থের কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? কোরআন কারীমের পূর্বে যে ধর্মগ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো, সেগুলোতে তৎকালীন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক বৈশিষ্টের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছে। আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছিলো।
.
কিন্তু আল কোরআন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে কোরআন পাঠানো হয়েছে, তাই এই কিতাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আর কোন নবীই তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের সর্বজনীনতা দাবি করেননি। বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া তার কিতাব বা ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যে আপনিও দেখবেন ইসলাম ছাড়া অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মই তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে না। বর্তমানকালে খৃষ্টানগণ তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে থাকে। অথচ তাদের তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাইবেলে যিশু বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অন্য কোনো গোত্রের জন্য নয়। (মথি : ১০/৬, ১৫/২২,২৪,২৫,২৬)।
.
তাই আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হবে—কোরআন এবং কোরআন যে দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, সে দ্বীন। আর কোরআন কেবলমাত্র একটি মাত্র দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; আর তা হলো ‘ইসলাম’। কোরআন বলছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ০৩ আয়াত]
.
আজাদ তার বইতে এ কথাও বলেছেন যে, প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে। আর মক্কার প্রচলিত ধর্ম থেকেই না কি ক্রমান্বয়ে ইসলাম বিকশিত হয়! । তিনি বলেন, “তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে...মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম।” [আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ৯৬]
.
আমরা আমাদের আলোচনার দ্বারা বুঝিয়েছি যে, ইসলাম কখনওই নিজেকে নতুন বলে দাবি করেনি। বরং ইসলাম বার বার উল্লেখ করেছে, এই দ্বীন পূর্ববর্তী নবীগণেরই দ্বীন। তাঁরা যে দ্বীন প্রচার করেছেন, সেই দ্বীন। তারা যে কথার দাওয়াত দিয়েছেন, ইসলামও ঠিক একই কথার দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ (স.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। [সূরা আন নাহল : ১২৩ আয়াত]
.
ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আর মুসলিম বলা হয় যারা ইসলামকে মেনে চলে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার সামনে যে সমর্পণ করে, সে-ই হলো মুসলিম। [ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃষ্ঠা : ২৪]