জবাব 1
বই: জবাবপ্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশনএই আলোচনাটি মূলত বইটিতে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের বিপরীতে আমার নিজস্ব মতামত। ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক লেখকের অনেকগুলো লেখা এখানে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে অল্প কিছু টপিকের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেলেও অধিকাংশ বিষয়ের ব্যাখ্যা আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেই আপত্তির জায়গা থেকেই কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই আলোচনা।১. বইটি শুরুই হয়েছে বিজ্ঞানের কথিত কিছু বিশ্বাস নিয়ে। আমরা জানি ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। কিন্তু লেখক বলেছেন বিজ্ঞানও কিছু কিছু বিষয় ধরে নেয় বা বিশ্বাস করে নেয়। প্রথমেই তিনি বলেছেন, ❝বিজ্ঞানের বিশ্বাসগুলোর মাঝে অন্যতম একটি বিশ্বাস হল - আমাদের ইন্দ্রিয় ও চিন্তাজগতের বাইরে এই বিশ্বজগতের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে।❞ লেখক যেটা বুঝাতে চেয়েছেন তা একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝালে বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন, আপনি বা আমি প্রতিনিয়ত সূর্য দেখি যা পূর্ব দিক থেকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, আপনি প্রতিদিন যে সূর্য দেখছেন তা আসলেই অস্তিত্বশীল না-কি সেটা একটা মরিচীকা মাত্র। মানে আপনি আমি বা পৃথিবীর সবাই যে সূর্য দেখছি তা যে আসলেই সূর্য তা বলা যাবে না। বরং এটা আমাদের দৃষ্টির ভ্রান্তিও হতে পারে। বিজ্ঞানের দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ভাবজগতে চলে গিয়েছেন বাস্তবকে অস্বীকার করে। যেমন কেউ কেউ বলে থাকেন, পুরো মহাবিশ্বই হলো একটা মায়ার জগৎ। সেই মায়ার জালে আমরা সকলেই আচ্ছন্ন!দ্বিতীয় পয়েন্টে লেখক বলেছেন, ❝আমরা যে যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব এটাও কিন্তু বিজ্ঞানের অনুমান।❞ লেখক কি বলতে চেয়েছেন, আমরা কোনো কিছু যৌক্তিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম নই? কিন্তু বিজ্ঞান জোর করে আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতে বলছে! এই পয়েন্টটিতে লেখকের স্ববিরোধীতাও ফুটে উঠেছে। লেখক ইসলামের পক্ষে নিজেই বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করছেন আবার নিজেই বলছেন তিনি যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব নন।চতুর্থ পয়েন্টে লেখক বলেছেন, বিজ্ঞান সকল প্রাকৃতিক ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা করে। কোনো অপ্রাকৃত বিষয়ের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে নেই। যা বাস্তবিক তাই নিয়েই বিজ্ঞানের কাজ এবং আলোচনা। এবং এই জাগতিক বিশ্লেষণ ও তার প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন সুফল পাচ্ছি। অপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণের আগে তার তো অস্তিত্ব থাকা চাই। কিন্তু অস্তিত্ব কোথায়? লেখক কীভাবে নিশ্চিত হলেন বা তার প্রমাণই বা কোথায়?২. পরবর্তী দু'টি টপিকে একজন স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা ও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। স্রষ্টা থাকাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি আছে স্রষ্টার নামে প্রচলিত ধর্মগুলো নিয়ে। একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও ইসলাম বা অন্যান্য ধর্ম সেই স্রষ্টা প্রবর্তিত কি-না তা সহজেই যাচাই করা যায় সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো দিয়ে। এবং সেই গ্রন্থগুলোতে প্রশ্ন তোলার মতো অনেক বিষয়ই বিদ্যমান। এই আর্টকেলটি আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে। কারণ আপত্তি তোলা হয় ইসলাম যাকে সৃষ্টিকর্তা বলে সেই আল্লাহ্কে নিয়ে কোনো পরম সৃষ্টিকর্তা নিয়ে নয়।৩. ❝হিউম্যান : মানব না দানব?❞ আর্টিকেলে লেখক বলেছেন, পশ্চিমা বিভিন্ন ভাবধারা (স্বাধীনতা-সমতা-নৈতিকতা-নিরপেক্ষতা-প্রকৃতিবাদ এসব চিন্তাদর্শন) আমাদের মগজে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। যেমন কেন মেয়েরা অর্ধেক সম্পত্তি পেল? কেন মেয়েদের সাক্ষীর দাম ছেলেদের অর্ধেক? কেন আল্লাহ যুদ্ধ করতে বললেন? কেন চার বিয়ের অনুমতি? কেন দাসদাসীর বিধান?পশ্চিমা ওই মতবাদগুলো কেন নিন্দনীয় বা অযৌক্তিক এবং ইসলামের উল্লেখিত বিধানগুলো কেন মহৎ এবং প্রশংসনীয় তার কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ লেখক করেননি। শুধু বলেছেন ইউরোপীয় ঐসব ভাবধারা মাথা থেকে বের করে ইসলামের একনিষ্ঠ আনুগত্যেই আছে মুক্তির পথ। ৪. ❝নারী-স্বাধীনতা নাকি দাসত্ব?❞ আর্টিকেলে লেখক একজন নারীকে জোরপূর্বক পুরুষের সমান হওয়ার যে প্রতিযোগীতা তার সমালোচনা করেছেন। পুরুষকে আইডল হিসেবে ধরে তার অনুসরণ ও অনুকরণ করার বিরোধিতা করেছেন। আমার মতে লেখক গোড়াতেই ভুল করেছেন সংজ্ঞাতে। কারণ নারী অধিকার বা নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে নারীকে কখনোই পুরুষের অনুরূপ হওয়ার দাবি করা হয় না। বরং একজন মানুষ হিসেবে একজন নারীর যে অধিকার, পুরুষের মতো স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই নারী অধিকারের মূলমন্ত্র। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামে কি নারী নিজের মত প্রকাশের অধিকার রাখে? একজন নারীর কাছে বিয়ের আগে পিতার এবং বিয়ের পরে স্বামীর নিঃশর্ত আনুগত্যই দাবি করে ইসলাম। নারী ও পুরুষের শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নারীকে যদি শুধু সন্তান জন্মদান ও স্বামীর সম্ভোগের মাধ্যম হিসেবে দেখি এবং ঘরের চারদেয়ালে বন্দি করে রাখি সেখানেই আপত্তির জায়গা।৫. কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপি ও আহরুফ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমে ভাষা নিয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমত, পৃথিবীর কোনো ভাষাই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। একভাষায় প্রকাশিত মনের ভাব অন্য ভাষায় পরিপূর্ণভাবে অনুবাদ বা রুপান্তর করা সম্ভব নয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার বাণী বা আদেশ সেই সীমাবদ্ধ একটি মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। আমরা যারা অনারব তারা বলতেই পারি সৃষ্টিকর্মে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন। দ্বিতীয়ত, ভাষার আরও একটি সমস্যা হলো তার আঞ্চলিকতা। বর্তমানে প্রত্যেক ভাষারই একটি ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন আছে। বাংলায় যেমন আছে প্রমিত বাংলা। অতীতে কিন্তু এমন কোনো ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন ছিলোনা। এবং এই সীমাবদ্ধতা স্বয়ং ঈশ্বরও এড়াতে পারেননি। তাই কুরআানকেও সাতটি আরবি হারফ (বহুবচনে আহরুফ) বা উপভাষায় নাজিল করতে হয়েছে। কুরআন সংকলের সময় খলিফা উসমান শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সনটি রেখে বাকীগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেন। ফলে পরবর্তীতে কুরআনের এই ভার্সনটিই প্রচলিত হয়। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, যেই সাত আরবি হারফে স্বয়ং স্রষ্টা কুরআন নাজিল করলেন এবং নবীজি নিজে তা সাহাবীদের শিক্ষা দিয়ে গেলেন সেই সাতটির পরিবর্তে শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সন প্রচলিত করার অধিকার খলিফা উসমান রাখেন কি-না? অনেকেই হয়তো বলবেন এটা সাহাবীদের ইজমা দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু যেটা স্বয়ং আল্লহ্ ও নবী কর্তৃক অনুমোদিত সেটাকে সংকুচিত করে একটি হারফে কুরআন প্রচলিত করা কি আল্লাহ্দ্রোহীতা নয়?৬. ❝নারীরা কি স্বল্পবুদ্ধির? তাদের অধিকাংশ কি জাহান্নামি?❞ এই টপিকে উল্লেখিত হাদিসের বক্তব্য এতোটাই স্পষ্ট যে এখানে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। কিন্তু লেখক যেভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন তা খুবই অযৌক্তিক মনে হয়েছে। হাদিসটির অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা হলো। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবীজি বলেন,❝ ...বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা বললেনঃ আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায়, হে আল্লাহ্র রসূল? তিনি বললেনঃ একজন মহিলার সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি সালাত ও সিয়াম হতে বিরত থাকে না? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি।(বুখারী ৩০৪, ১৪৬২, ১৯৫১, ২৬৫৮; মুসলিম ১/৩৪, হাঃ ৭৯, ৮০ আহমাদ ৫৪৪৩) (আ.প্র. ২৯৩, ই.ফা. ২৯৮)৭. দাসপ্রথা নিয়ে অনেককিছু বলা যায়। সংক্ষিপ্ত করার অভিপ্রায়ে এখানে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করবো না। তর্কসাপেক্ষে যদি তৎকালীন যুগের বিবেচনায় মেনেও নিই দাসপ্রথাকে কিন্তু বর্তমানে কি তা মানা সম্ভব? যদি বলা হয় ইসলামি এই বিধানকে তৎকালীন পরিবেশ বিবেচনায় মেনে নিতে হবে তাহলে এটাও বলা যায় যে, কুরআনের বিধানাবলিও সেই যুগের জন্যই প্রযোজ্য, বর্তমানের জন্য নয়।৮. ❝উৎসর্গের উৎসবে❞ লেখক ঈদুল আযহায় পশুহত্যার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কুরবানির মাংস যেহেতু খাওয়া হয় এবং গরীবদের মাঝে দান করা হয় কাজেই এই পশুহত্যা অপরাধ নয় বা অনৈতিক নয়। লেখক এখানে কুরবানিকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে প্রাইমারি উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুরবানির প্রাইমারি উদ্দেশ্য কিন্তু মাংস ভক্ষণ নয় বরং আল্লাহ্র আদেশে পশু জবাই করা। আর এখানেই মূলত আপত্তি। আল্লাহ্ কেন বান্দার তাকওয়া পরীক্ষা করতে পশুহত্যা করতে আদেশ দিলেন তা বোধগম্য নয়।৯. ❝তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র❞ আর্টিকেলে লেখক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূল টেক্সট বা বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গান চলে গিয়েছেন। প্রথমে আয়াতের অংশটি দেখে নিই। ❝তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।❞ আচ্ছা আয়াতটি পড়ে কি আপনার কখনো মনে হচ্ছে শস্যক্ষেতে যেমন বীজ থেকে নতুন শস্য উৎপন্ন হয় ঠিক সেরকমই নারীর দেহকে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে আয়াতটিতে শস্যক্ষেত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। না-কি এখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে নিজের ইচ্ছামত শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবে সেই বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই আয়াতটিতে স্ত্রী উপর পুরুষের ইচ্ছাকৃত যৌনমিলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লেখক পুরো আর্টিকেল জুড়ে নারীকে সন্তান উৎপাদনের শস্যক্ষেত্র হিসেব উল্লেখ করেছেন এবং সেইমত ব্যাখ্যা করেছেন। এবং ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মতো শুক্রানুর সাথে ডিম্বাণুর নিষেক ও নারীর গর্ভাশয়ে কীভাবে সন্তান বৃদ্ধি লাভ করে তার প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং মাটিতে বীজ থেকে কীভাবে চারার অঙ্কুরোদগমন হয় ও বৃদ্ধি পায় তারও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। পড়তে গিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি যদিও আমি বিজ্ঞানেরই ছাত্র। আরও বিভিন্ন টপিকে আপত্তি আছে। যেমন, ❝ভিন্ন কিরাআতে ভিন্ন কথা❞, ❝স্রষ্টার প্রজ্ঞার অনন্য এক নিদর্শন - নাসখ❞, ❝অলৌকিক কিছু ঘটলে❞, ❝হিজড়াদের হত্যা করা❞, ❝একটি প্রশ্ন, একটি উত্তর❞ ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে আর কিছু লিখছি না। আলোচনা এমনিতেই বড়ো হয়ে গিয়েছে।বর্তমানে এধরনের অসংখ্য বই লেখা হচ্ছে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখি। কারণ ধর্ম ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আপত্তির জায়গাগুলো কি মানুষ তা জানতে পারছে এবং তার জবাবগুলোর মাধ্যমে সেই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ও চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত হচ্ছে।
An Najahah Shop
Category List
All products

বই: জবাব
প্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশন
এই আলোচনাটি মূলত বইটিতে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের বিপরীতে আমার নিজস্ব মতামত। ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক লেখকের অনেকগুলো লেখা এখানে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে অল্প কিছু টপিকের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেলেও অধিকাংশ বিষয়ের ব্যাখ্যা আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেই আপত্তির জায়গা থেকেই কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই আলোচনা।
১. বইটি শুরুই হয়েছে বিজ্ঞানের কথিত কিছু বিশ্বাস নিয়ে। আমরা জানি ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। কিন্তু লেখক বলেছেন বিজ্ঞানও কিছু কিছু বিষয় ধরে নেয় বা বিশ্বাস করে নেয়। প্রথমেই তিনি বলেছেন, ❝বিজ্ঞানের বিশ্বাসগুলোর মাঝে অন্যতম একটি বিশ্বাস হল - আমাদের ইন্দ্রিয় ও চিন্তাজগতের বাইরে এই বিশ্বজগতের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে।❞ লেখক যেটা বুঝাতে চেয়েছেন তা একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝালে বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন, আপনি বা আমি প্রতিনিয়ত সূর্য দেখি যা পূর্ব দিক থেকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, আপনি প্রতিদিন যে সূর্য দেখছেন তা আসলেই অস্তিত্বশীল না-কি সেটা একটা মরিচীকা মাত্র। মানে আপনি আমি বা পৃথিবীর সবাই যে সূর্য দেখছি তা যে আসলেই সূর্য তা বলা যাবে না। বরং এটা আমাদের দৃষ্টির ভ্রান্তিও হতে পারে। বিজ্ঞানের দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ভাবজগতে চলে গিয়েছেন বাস্তবকে অস্বীকার করে। যেমন কেউ কেউ বলে থাকেন, পুরো মহাবিশ্বই হলো একটা মায়ার জগৎ। সেই মায়ার জালে আমরা সকলেই আচ্ছন্ন!
দ্বিতীয় পয়েন্টে লেখক বলেছেন, ❝আমরা যে যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব এটাও কিন্তু বিজ্ঞানের অনুমান।❞ লেখক কি বলতে চেয়েছেন, আমরা কোনো কিছু যৌক্তিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম নই? কিন্তু বিজ্ঞান জোর করে আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতে বলছে! এই পয়েন্টটিতে লেখকের স্ববিরোধীতাও ফুটে উঠেছে। লেখক ইসলামের পক্ষে নিজেই বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করছেন আবার নিজেই বলছেন তিনি যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব নন।
চতুর্থ পয়েন্টে লেখক বলেছেন, বিজ্ঞান সকল প্রাকৃতিক ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা করে। কোনো অপ্রাকৃত বিষয়ের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে নেই। যা বাস্তবিক তাই নিয়েই বিজ্ঞানের কাজ এবং আলোচনা। এবং এই জাগতিক বিশ্লেষণ ও তার প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন সুফল পাচ্ছি। অপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণের আগে তার তো অস্তিত্ব থাকা চাই। কিন্তু অস্তিত্ব কোথায়? লেখক কীভাবে নিশ্চিত হলেন বা তার প্রমাণই বা কোথায়?
২. পরবর্তী দু'টি টপিকে একজন স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা ও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। স্রষ্টা থাকাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি আছে স্রষ্টার নামে প্রচলিত ধর্মগুলো নিয়ে। একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও ইসলাম বা অন্যান্য ধর্ম সেই স্রষ্টা প্রবর্তিত কি-না তা সহজেই যাচাই করা যায় সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো দিয়ে। এবং সেই গ্রন্থগুলোতে প্রশ্ন তোলার মতো অনেক বিষয়ই বিদ্যমান। এই আর্টকেলটি আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে। কারণ আপত্তি তোলা হয় ইসলাম যাকে সৃষ্টিকর্তা বলে সেই আল্লাহ্কে নিয়ে কোনো পরম সৃষ্টিকর্তা নিয়ে নয়।
৩. ❝হিউম্যান : মানব না দানব?❞ আর্টিকেলে লেখক বলেছেন, পশ্চিমা বিভিন্ন ভাবধারা (স্বাধীনতা-সমতা-নৈতিকতা-নিরপেক্ষতা-প্রকৃতিবাদ এসব চিন্তাদর্শন) আমাদের মগজে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। যেমন কেন মেয়েরা অর্ধেক সম্পত্তি পেল? কেন মেয়েদের সাক্ষীর দাম ছেলেদের অর্ধেক? কেন আল্লাহ যুদ্ধ করতে বললেন? কেন চার বিয়ের অনুমতি? কেন দাসদাসীর বিধান?
পশ্চিমা ওই মতবাদগুলো কেন নিন্দনীয় বা অযৌক্তিক এবং ইসলামের উল্লেখিত বিধানগুলো কেন মহৎ এবং প্রশংসনীয় তার কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ লেখক করেননি। শুধু বলেছেন ইউরোপীয় ঐসব ভাবধারা মাথা থেকে বের করে ইসলামের একনিষ্ঠ আনুগত্যেই আছে মুক্তির পথ।
৪. ❝নারী-স্বাধীনতা নাকি দাসত্ব?❞ আর্টিকেলে লেখক একজন নারীকে জোরপূর্বক পুরুষের সমান হওয়ার যে প্রতিযোগীতা তার সমালোচনা করেছেন। পুরুষকে আইডল হিসেবে ধরে তার অনুসরণ ও অনুকরণ করার বিরোধিতা করেছেন। আমার মতে লেখক গোড়াতেই ভুল করেছেন সংজ্ঞাতে। কারণ নারী অধিকার বা নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে নারীকে কখনোই পুরুষের অনুরূপ হওয়ার দাবি করা হয় না। বরং একজন মানুষ হিসেবে একজন নারীর যে অধিকার, পুরুষের মতো স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই নারী অধিকারের মূলমন্ত্র। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামে কি নারী নিজের মত প্রকাশের অধিকার রাখে? একজন নারীর কাছে বিয়ের আগে পিতার এবং বিয়ের পরে স্বামীর নিঃশর্ত আনুগত্যই দাবি করে ইসলাম। নারী ও পুরুষের শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নারীকে যদি শুধু সন্তান জন্মদান ও স্বামীর সম্ভোগের মাধ্যম হিসেবে দেখি এবং ঘরের চারদেয়ালে বন্দি করে রাখি সেখানেই আপত্তির জায়গা।
৫. কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপি ও আহরুফ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমে ভাষা নিয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমত, পৃথিবীর কোনো ভাষাই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। একভাষায় প্রকাশিত মনের ভাব অন্য ভাষায় পরিপূর্ণভাবে অনুবাদ বা রুপান্তর করা সম্ভব নয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার বাণী বা আদেশ সেই সীমাবদ্ধ একটি মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। আমরা যারা অনারব তারা বলতেই পারি সৃষ্টিকর্মে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন।
দ্বিতীয়ত, ভাষার আরও একটি সমস্যা হলো তার আঞ্চলিকতা। বর্তমানে প্রত্যেক ভাষারই একটি ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন আছে। বাংলায় যেমন আছে প্রমিত বাংলা। অতীতে কিন্তু এমন কোনো ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন ছিলোনা। এবং এই সীমাবদ্ধতা স্বয়ং ঈশ্বরও এড়াতে পারেননি। তাই কুরআানকেও সাতটি আরবি হারফ (বহুবচনে আহরুফ) বা উপভাষায় নাজিল করতে হয়েছে। কুরআন সংকলের সময় খলিফা উসমান শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সনটি রেখে বাকীগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেন। ফলে পরবর্তীতে কুরআনের এই ভার্সনটিই প্রচলিত হয়। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, যেই সাত আরবি হারফে স্বয়ং স্রষ্টা কুরআন নাজিল করলেন এবং নবীজি নিজে তা সাহাবীদের শিক্ষা দিয়ে গেলেন সেই সাতটির পরিবর্তে শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সন প্রচলিত করার অধিকার খলিফা উসমান রাখেন কি-না? অনেকেই হয়তো বলবেন এটা সাহাবীদের ইজমা দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু যেটা স্বয়ং আল্লহ্ ও নবী কর্তৃক অনুমোদিত সেটাকে সংকুচিত করে একটি হারফে কুরআন প্রচলিত করা কি আল্লাহ্দ্রোহীতা নয়?
৬. ❝নারীরা কি স্বল্পবুদ্ধির? তাদের অধিকাংশ কি জাহান্নামি?❞ এই টপিকে উল্লেখিত হাদিসের বক্তব্য এতোটাই স্পষ্ট যে এখানে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। কিন্তু লেখক যেভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন তা খুবই অযৌক্তিক মনে হয়েছে। হাদিসটির অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা হলো। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবীজি বলেন,❝ ...বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা বললেনঃ আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায়, হে আল্লাহ্র রসূল? তিনি বললেনঃ একজন মহিলার সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি সালাত ও সিয়াম হতে বিরত থাকে না? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি।
(বুখারী ৩০৪, ১৪৬২, ১৯৫১, ২৬৫৮; মুসলিম ১/৩৪, হাঃ ৭৯, ৮০ আহমাদ ৫৪৪৩) (আ.প্র. ২৯৩, ই.ফা. ২৯৮)
৭. দাসপ্রথা নিয়ে অনেককিছু বলা যায়। সংক্ষিপ্ত করার অভিপ্রায়ে এখানে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করবো না। তর্কসাপেক্ষে যদি তৎকালীন যুগের বিবেচনায় মেনেও নিই দাসপ্রথাকে কিন্তু বর্তমানে কি তা মানা সম্ভব? যদি বলা হয় ইসলামি এই বিধানকে তৎকালীন পরিবেশ বিবেচনায় মেনে নিতে হবে তাহলে এটাও বলা যায় যে, কুরআনের বিধানাবলিও সেই যুগের জন্যই প্রযোজ্য, বর্তমানের জন্য নয়।
৮. ❝উৎসর্গের উৎসবে❞ লেখক ঈদুল আযহায় পশুহত্যার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কুরবানির মাংস যেহেতু খাওয়া হয় এবং গরীবদের মাঝে দান করা হয় কাজেই এই পশুহত্যা অপরাধ নয় বা অনৈতিক নয়। লেখক এখানে কুরবানিকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে প্রাইমারি উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুরবানির প্রাইমারি উদ্দেশ্য কিন্তু মাংস ভক্ষণ নয় বরং আল্লাহ্র আদেশে পশু জবাই করা। আর এখানেই মূলত আপত্তি। আল্লাহ্ কেন বান্দার তাকওয়া পরীক্ষা করতে পশুহত্যা করতে আদেশ দিলেন তা বোধগম্য নয়।
৯. ❝তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র❞ আর্টিকেলে লেখক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূল টেক্সট বা বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গান চলে গিয়েছেন। প্রথমে আয়াতের অংশটি দেখে নিই। ❝তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।❞ আচ্ছা আয়াতটি পড়ে কি আপনার কখনো মনে হচ্ছে শস্যক্ষেতে যেমন বীজ থেকে নতুন শস্য উৎপন্ন হয় ঠিক সেরকমই নারীর দেহকে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে আয়াতটিতে শস্যক্ষেত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। না-কি এখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে নিজের ইচ্ছামত শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবে সেই বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই আয়াতটিতে স্ত্রী উপর পুরুষের ইচ্ছাকৃত যৌনমিলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লেখক পুরো আর্টিকেল জুড়ে নারীকে সন্তান উৎপাদনের শস্যক্ষেত্র হিসেব উল্লেখ করেছেন এবং সেইমত ব্যাখ্যা করেছেন। এবং ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মতো শুক্রানুর সাথে ডিম্বাণুর নিষেক ও নারীর গর্ভাশয়ে কীভাবে সন্তান বৃদ্ধি লাভ করে তার প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং মাটিতে বীজ থেকে কীভাবে চারার অঙ্কুরোদগমন হয় ও বৃদ্ধি পায় তারও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। পড়তে গিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি যদিও আমি বিজ্ঞানেরই ছাত্র।
আরও বিভিন্ন টপিকে আপত্তি আছে। যেমন, ❝ভিন্ন কিরাআতে ভিন্ন কথা❞, ❝স্রষ্টার প্রজ্ঞার অনন্য এক নিদর্শন - নাসখ❞, ❝অলৌকিক কিছু ঘটলে❞, ❝হিজড়াদের হত্যা করা❞, ❝একটি প্রশ্ন, একটি উত্তর❞ ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে আর কিছু লিখছি না। আলোচনা এমনিতেই বড়ো হয়ে গিয়েছে।
বর্তমানে এধরনের অসংখ্য বই লেখা হচ্ছে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখি। কারণ ধর্ম ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আপত্তির জায়গাগুলো কি মানুষ তা জানতে পারছে এবং তার জবাবগুলোর মাধ্যমে সেই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ও চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত হচ্ছে।
প্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশন
এই আলোচনাটি মূলত বইটিতে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের বিপরীতে আমার নিজস্ব মতামত। ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক লেখকের অনেকগুলো লেখা এখানে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে অল্প কিছু টপিকের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেলেও অধিকাংশ বিষয়ের ব্যাখ্যা আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেই আপত্তির জায়গা থেকেই কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই আলোচনা।
১. বইটি শুরুই হয়েছে বিজ্ঞানের কথিত কিছু বিশ্বাস নিয়ে। আমরা জানি ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। কিন্তু লেখক বলেছেন বিজ্ঞানও কিছু কিছু বিষয় ধরে নেয় বা বিশ্বাস করে নেয়। প্রথমেই তিনি বলেছেন, ❝বিজ্ঞানের বিশ্বাসগুলোর মাঝে অন্যতম একটি বিশ্বাস হল - আমাদের ইন্দ্রিয় ও চিন্তাজগতের বাইরে এই বিশ্বজগতের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে।❞ লেখক যেটা বুঝাতে চেয়েছেন তা একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝালে বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন, আপনি বা আমি প্রতিনিয়ত সূর্য দেখি যা পূর্ব দিক থেকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, আপনি প্রতিদিন যে সূর্য দেখছেন তা আসলেই অস্তিত্বশীল না-কি সেটা একটা মরিচীকা মাত্র। মানে আপনি আমি বা পৃথিবীর সবাই যে সূর্য দেখছি তা যে আসলেই সূর্য তা বলা যাবে না। বরং এটা আমাদের দৃষ্টির ভ্রান্তিও হতে পারে। বিজ্ঞানের দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ভাবজগতে চলে গিয়েছেন বাস্তবকে অস্বীকার করে। যেমন কেউ কেউ বলে থাকেন, পুরো মহাবিশ্বই হলো একটা মায়ার জগৎ। সেই মায়ার জালে আমরা সকলেই আচ্ছন্ন!
দ্বিতীয় পয়েন্টে লেখক বলেছেন, ❝আমরা যে যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব এটাও কিন্তু বিজ্ঞানের অনুমান।❞ লেখক কি বলতে চেয়েছেন, আমরা কোনো কিছু যৌক্তিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম নই? কিন্তু বিজ্ঞান জোর করে আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতে বলছে! এই পয়েন্টটিতে লেখকের স্ববিরোধীতাও ফুটে উঠেছে। লেখক ইসলামের পক্ষে নিজেই বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করছেন আবার নিজেই বলছেন তিনি যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব নন।
চতুর্থ পয়েন্টে লেখক বলেছেন, বিজ্ঞান সকল প্রাকৃতিক ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা করে। কোনো অপ্রাকৃত বিষয়ের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে নেই। যা বাস্তবিক তাই নিয়েই বিজ্ঞানের কাজ এবং আলোচনা। এবং এই জাগতিক বিশ্লেষণ ও তার প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন সুফল পাচ্ছি। অপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণের আগে তার তো অস্তিত্ব থাকা চাই। কিন্তু অস্তিত্ব কোথায়? লেখক কীভাবে নিশ্চিত হলেন বা তার প্রমাণই বা কোথায়?
২. পরবর্তী দু'টি টপিকে একজন স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা ও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। স্রষ্টা থাকাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি আছে স্রষ্টার নামে প্রচলিত ধর্মগুলো নিয়ে। একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও ইসলাম বা অন্যান্য ধর্ম সেই স্রষ্টা প্রবর্তিত কি-না তা সহজেই যাচাই করা যায় সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো দিয়ে। এবং সেই গ্রন্থগুলোতে প্রশ্ন তোলার মতো অনেক বিষয়ই বিদ্যমান। এই আর্টকেলটি আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে। কারণ আপত্তি তোলা হয় ইসলাম যাকে সৃষ্টিকর্তা বলে সেই আল্লাহ্কে নিয়ে কোনো পরম সৃষ্টিকর্তা নিয়ে নয়।
৩. ❝হিউম্যান : মানব না দানব?❞ আর্টিকেলে লেখক বলেছেন, পশ্চিমা বিভিন্ন ভাবধারা (স্বাধীনতা-সমতা-নৈতিকতা-নিরপেক্ষতা-প্রকৃতিবাদ এসব চিন্তাদর্শন) আমাদের মগজে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। যেমন কেন মেয়েরা অর্ধেক সম্পত্তি পেল? কেন মেয়েদের সাক্ষীর দাম ছেলেদের অর্ধেক? কেন আল্লাহ যুদ্ধ করতে বললেন? কেন চার বিয়ের অনুমতি? কেন দাসদাসীর বিধান?
পশ্চিমা ওই মতবাদগুলো কেন নিন্দনীয় বা অযৌক্তিক এবং ইসলামের উল্লেখিত বিধানগুলো কেন মহৎ এবং প্রশংসনীয় তার কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ লেখক করেননি। শুধু বলেছেন ইউরোপীয় ঐসব ভাবধারা মাথা থেকে বের করে ইসলামের একনিষ্ঠ আনুগত্যেই আছে মুক্তির পথ।
৪. ❝নারী-স্বাধীনতা নাকি দাসত্ব?❞ আর্টিকেলে লেখক একজন নারীকে জোরপূর্বক পুরুষের সমান হওয়ার যে প্রতিযোগীতা তার সমালোচনা করেছেন। পুরুষকে আইডল হিসেবে ধরে তার অনুসরণ ও অনুকরণ করার বিরোধিতা করেছেন। আমার মতে লেখক গোড়াতেই ভুল করেছেন সংজ্ঞাতে। কারণ নারী অধিকার বা নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে নারীকে কখনোই পুরুষের অনুরূপ হওয়ার দাবি করা হয় না। বরং একজন মানুষ হিসেবে একজন নারীর যে অধিকার, পুরুষের মতো স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই নারী অধিকারের মূলমন্ত্র। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামে কি নারী নিজের মত প্রকাশের অধিকার রাখে? একজন নারীর কাছে বিয়ের আগে পিতার এবং বিয়ের পরে স্বামীর নিঃশর্ত আনুগত্যই দাবি করে ইসলাম। নারী ও পুরুষের শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নারীকে যদি শুধু সন্তান জন্মদান ও স্বামীর সম্ভোগের মাধ্যম হিসেবে দেখি এবং ঘরের চারদেয়ালে বন্দি করে রাখি সেখানেই আপত্তির জায়গা।
৫. কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপি ও আহরুফ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমে ভাষা নিয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমত, পৃথিবীর কোনো ভাষাই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। একভাষায় প্রকাশিত মনের ভাব অন্য ভাষায় পরিপূর্ণভাবে অনুবাদ বা রুপান্তর করা সম্ভব নয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার বাণী বা আদেশ সেই সীমাবদ্ধ একটি মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। আমরা যারা অনারব তারা বলতেই পারি সৃষ্টিকর্মে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন।
দ্বিতীয়ত, ভাষার আরও একটি সমস্যা হলো তার আঞ্চলিকতা। বর্তমানে প্রত্যেক ভাষারই একটি ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন আছে। বাংলায় যেমন আছে প্রমিত বাংলা। অতীতে কিন্তু এমন কোনো ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন ছিলোনা। এবং এই সীমাবদ্ধতা স্বয়ং ঈশ্বরও এড়াতে পারেননি। তাই কুরআানকেও সাতটি আরবি হারফ (বহুবচনে আহরুফ) বা উপভাষায় নাজিল করতে হয়েছে। কুরআন সংকলের সময় খলিফা উসমান শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সনটি রেখে বাকীগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেন। ফলে পরবর্তীতে কুরআনের এই ভার্সনটিই প্রচলিত হয়। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, যেই সাত আরবি হারফে স্বয়ং স্রষ্টা কুরআন নাজিল করলেন এবং নবীজি নিজে তা সাহাবীদের শিক্ষা দিয়ে গেলেন সেই সাতটির পরিবর্তে শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সন প্রচলিত করার অধিকার খলিফা উসমান রাখেন কি-না? অনেকেই হয়তো বলবেন এটা সাহাবীদের ইজমা দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু যেটা স্বয়ং আল্লহ্ ও নবী কর্তৃক অনুমোদিত সেটাকে সংকুচিত করে একটি হারফে কুরআন প্রচলিত করা কি আল্লাহ্দ্রোহীতা নয়?
৬. ❝নারীরা কি স্বল্পবুদ্ধির? তাদের অধিকাংশ কি জাহান্নামি?❞ এই টপিকে উল্লেখিত হাদিসের বক্তব্য এতোটাই স্পষ্ট যে এখানে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। কিন্তু লেখক যেভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন তা খুবই অযৌক্তিক মনে হয়েছে। হাদিসটির অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা হলো। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবীজি বলেন,❝ ...বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা বললেনঃ আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায়, হে আল্লাহ্র রসূল? তিনি বললেনঃ একজন মহিলার সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি সালাত ও সিয়াম হতে বিরত থাকে না? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি।
(বুখারী ৩০৪, ১৪৬২, ১৯৫১, ২৬৫৮; মুসলিম ১/৩৪, হাঃ ৭৯, ৮০ আহমাদ ৫৪৪৩) (আ.প্র. ২৯৩, ই.ফা. ২৯৮)
৭. দাসপ্রথা নিয়ে অনেককিছু বলা যায়। সংক্ষিপ্ত করার অভিপ্রায়ে এখানে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করবো না। তর্কসাপেক্ষে যদি তৎকালীন যুগের বিবেচনায় মেনেও নিই দাসপ্রথাকে কিন্তু বর্তমানে কি তা মানা সম্ভব? যদি বলা হয় ইসলামি এই বিধানকে তৎকালীন পরিবেশ বিবেচনায় মেনে নিতে হবে তাহলে এটাও বলা যায় যে, কুরআনের বিধানাবলিও সেই যুগের জন্যই প্রযোজ্য, বর্তমানের জন্য নয়।
৮. ❝উৎসর্গের উৎসবে❞ লেখক ঈদুল আযহায় পশুহত্যার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কুরবানির মাংস যেহেতু খাওয়া হয় এবং গরীবদের মাঝে দান করা হয় কাজেই এই পশুহত্যা অপরাধ নয় বা অনৈতিক নয়। লেখক এখানে কুরবানিকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে প্রাইমারি উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুরবানির প্রাইমারি উদ্দেশ্য কিন্তু মাংস ভক্ষণ নয় বরং আল্লাহ্র আদেশে পশু জবাই করা। আর এখানেই মূলত আপত্তি। আল্লাহ্ কেন বান্দার তাকওয়া পরীক্ষা করতে পশুহত্যা করতে আদেশ দিলেন তা বোধগম্য নয়।
৯. ❝তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র❞ আর্টিকেলে লেখক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূল টেক্সট বা বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গান চলে গিয়েছেন। প্রথমে আয়াতের অংশটি দেখে নিই। ❝তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।❞ আচ্ছা আয়াতটি পড়ে কি আপনার কখনো মনে হচ্ছে শস্যক্ষেতে যেমন বীজ থেকে নতুন শস্য উৎপন্ন হয় ঠিক সেরকমই নারীর দেহকে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে আয়াতটিতে শস্যক্ষেত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। না-কি এখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে নিজের ইচ্ছামত শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবে সেই বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই আয়াতটিতে স্ত্রী উপর পুরুষের ইচ্ছাকৃত যৌনমিলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লেখক পুরো আর্টিকেল জুড়ে নারীকে সন্তান উৎপাদনের শস্যক্ষেত্র হিসেব উল্লেখ করেছেন এবং সেইমত ব্যাখ্যা করেছেন। এবং ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মতো শুক্রানুর সাথে ডিম্বাণুর নিষেক ও নারীর গর্ভাশয়ে কীভাবে সন্তান বৃদ্ধি লাভ করে তার প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং মাটিতে বীজ থেকে কীভাবে চারার অঙ্কুরোদগমন হয় ও বৃদ্ধি পায় তারও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। পড়তে গিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি যদিও আমি বিজ্ঞানেরই ছাত্র।
আরও বিভিন্ন টপিকে আপত্তি আছে। যেমন, ❝ভিন্ন কিরাআতে ভিন্ন কথা❞, ❝স্রষ্টার প্রজ্ঞার অনন্য এক নিদর্শন - নাসখ❞, ❝অলৌকিক কিছু ঘটলে❞, ❝হিজড়াদের হত্যা করা❞, ❝একটি প্রশ্ন, একটি উত্তর❞ ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে আর কিছু লিখছি না। আলোচনা এমনিতেই বড়ো হয়ে গিয়েছে।
বর্তমানে এধরনের অসংখ্য বই লেখা হচ্ছে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখি। কারণ ধর্ম ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আপত্তির জায়গাগুলো কি মানুষ তা জানতে পারছে এবং তার জবাবগুলোর মাধ্যমে সেই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ও চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত হচ্ছে।
জবাব 1
220 BDT315 BDTSave 95 BDT
1
বই: জবাব
প্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশন
এই আলোচনাটি মূলত বইটিতে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের বিপরীতে আমার নিজস্ব মতামত। ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক লেখকের অনেকগুলো লেখা এখানে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে অল্প কিছু টপিকের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেলেও অধিকাংশ বিষয়ের ব্যাখ্যা আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেই আপত্তির জায়গা থেকেই কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই আলোচনা।
১. বইটি শুরুই হয়েছে বিজ্ঞানের কথিত কিছু বিশ্বাস নিয়ে। আমরা জানি ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। কিন্তু লেখক বলেছেন বিজ্ঞানও কিছু কিছু বিষয় ধরে নেয় বা বিশ্বাস করে নেয়। প্রথমেই তিনি বলেছেন, ❝বিজ্ঞানের বিশ্বাসগুলোর মাঝে অন্যতম একটি বিশ্বাস হল - আমাদের ইন্দ্রিয় ও চিন্তাজগতের বাইরে এই বিশ্বজগতের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে।❞ লেখক যেটা বুঝাতে চেয়েছেন তা একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝালে বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন, আপনি বা আমি প্রতিনিয়ত সূর্য দেখি যা পূর্ব দিক থেকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, আপনি প্রতিদিন যে সূর্য দেখছেন তা আসলেই অস্তিত্বশীল না-কি সেটা একটা মরিচীকা মাত্র। মানে আপনি আমি বা পৃথিবীর সবাই যে সূর্য দেখছি তা যে আসলেই সূর্য তা বলা যাবে না। বরং এটা আমাদের দৃষ্টির ভ্রান্তিও হতে পারে। বিজ্ঞানের দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ভাবজগতে চলে গিয়েছেন বাস্তবকে অস্বীকার করে। যেমন কেউ কেউ বলে থাকেন, পুরো মহাবিশ্বই হলো একটা মায়ার জগৎ। সেই মায়ার জালে আমরা সকলেই আচ্ছন্ন!
দ্বিতীয় পয়েন্টে লেখক বলেছেন, ❝আমরা যে যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব এটাও কিন্তু বিজ্ঞানের অনুমান।❞ লেখক কি বলতে চেয়েছেন, আমরা কোনো কিছু যৌক্তিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম নই? কিন্তু বিজ্ঞান জোর করে আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতে বলছে! এই পয়েন্টটিতে লেখকের স্ববিরোধীতাও ফুটে উঠেছে। লেখক ইসলামের পক্ষে নিজেই বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করছেন আবার নিজেই বলছেন তিনি যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব নন।
চতুর্থ পয়েন্টে লেখক বলেছেন, বিজ্ঞান সকল প্রাকৃতিক ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা করে। কোনো অপ্রাকৃত বিষয়ের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে নেই। যা বাস্তবিক তাই নিয়েই বিজ্ঞানের কাজ এবং আলোচনা। এবং এই জাগতিক বিশ্লেষণ ও তার প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন সুফল পাচ্ছি। অপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণের আগে তার তো অস্তিত্ব থাকা চাই। কিন্তু অস্তিত্ব কোথায়? লেখক কীভাবে নিশ্চিত হলেন বা তার প্রমাণই বা কোথায়?
২. পরবর্তী দু'টি টপিকে একজন স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা ও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। স্রষ্টা থাকাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি আছে স্রষ্টার নামে প্রচলিত ধর্মগুলো নিয়ে। একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও ইসলাম বা অন্যান্য ধর্ম সেই স্রষ্টা প্রবর্তিত কি-না তা সহজেই যাচাই করা যায় সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো দিয়ে। এবং সেই গ্রন্থগুলোতে প্রশ্ন তোলার মতো অনেক বিষয়ই বিদ্যমান। এই আর্টকেলটি আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে। কারণ আপত্তি তোলা হয় ইসলাম যাকে সৃষ্টিকর্তা বলে সেই আল্লাহ্কে নিয়ে কোনো পরম সৃষ্টিকর্তা নিয়ে নয়।
৩. ❝হিউম্যান : মানব না দানব?❞ আর্টিকেলে লেখক বলেছেন, পশ্চিমা বিভিন্ন ভাবধারা (স্বাধীনতা-সমতা-নৈতিকতা-নিরপেক্ষতা-প্রকৃতিবাদ এসব চিন্তাদর্শন) আমাদের মগজে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। যেমন কেন মেয়েরা অর্ধেক সম্পত্তি পেল? কেন মেয়েদের সাক্ষীর দাম ছেলেদের অর্ধেক? কেন আল্লাহ যুদ্ধ করতে বললেন? কেন চার বিয়ের অনুমতি? কেন দাসদাসীর বিধান?
পশ্চিমা ওই মতবাদগুলো কেন নিন্দনীয় বা অযৌক্তিক এবং ইসলামের উল্লেখিত বিধানগুলো কেন মহৎ এবং প্রশংসনীয় তার কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ লেখক করেননি। শুধু বলেছেন ইউরোপীয় ঐসব ভাবধারা মাথা থেকে বের করে ইসলামের একনিষ্ঠ আনুগত্যেই আছে মুক্তির পথ।
৪. ❝নারী-স্বাধীনতা নাকি দাসত্ব?❞ আর্টিকেলে লেখক একজন নারীকে জোরপূর্বক পুরুষের সমান হওয়ার যে প্রতিযোগীতা তার সমালোচনা করেছেন। পুরুষকে আইডল হিসেবে ধরে তার অনুসরণ ও অনুকরণ করার বিরোধিতা করেছেন। আমার মতে লেখক গোড়াতেই ভুল করেছেন সংজ্ঞাতে। কারণ নারী অধিকার বা নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে নারীকে কখনোই পুরুষের অনুরূপ হওয়ার দাবি করা হয় না। বরং একজন মানুষ হিসেবে একজন নারীর যে অধিকার, পুরুষের মতো স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই নারী অধিকারের মূলমন্ত্র। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামে কি নারী নিজের মত প্রকাশের অধিকার রাখে? একজন নারীর কাছে বিয়ের আগে পিতার এবং বিয়ের পরে স্বামীর নিঃশর্ত আনুগত্যই দাবি করে ইসলাম। নারী ও পুরুষের শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নারীকে যদি শুধু সন্তান জন্মদান ও স্বামীর সম্ভোগের মাধ্যম হিসেবে দেখি এবং ঘরের চারদেয়ালে বন্দি করে রাখি সেখানেই আপত্তির জায়গা।
৫. কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপি ও আহরুফ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমে ভাষা নিয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমত, পৃথিবীর কোনো ভাষাই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। একভাষায় প্রকাশিত মনের ভাব অন্য ভাষায় পরিপূর্ণভাবে অনুবাদ বা রুপান্তর করা সম্ভব নয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার বাণী বা আদেশ সেই সীমাবদ্ধ একটি মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। আমরা যারা অনারব তারা বলতেই পারি সৃষ্টিকর্মে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন।
দ্বিতীয়ত, ভাষার আরও একটি সমস্যা হলো তার আঞ্চলিকতা। বর্তমানে প্রত্যেক ভাষারই একটি ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন আছে। বাংলায় যেমন আছে প্রমিত বাংলা। অতীতে কিন্তু এমন কোনো ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন ছিলোনা। এবং এই সীমাবদ্ধতা স্বয়ং ঈশ্বরও এড়াতে পারেননি। তাই কুরআানকেও সাতটি আরবি হারফ (বহুবচনে আহরুফ) বা উপভাষায় নাজিল করতে হয়েছে। কুরআন সংকলের সময় খলিফা উসমান শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সনটি রেখে বাকীগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেন। ফলে পরবর্তীতে কুরআনের এই ভার্সনটিই প্রচলিত হয়। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, যেই সাত আরবি হারফে স্বয়ং স্রষ্টা কুরআন নাজিল করলেন এবং নবীজি নিজে তা সাহাবীদের শিক্ষা দিয়ে গেলেন সেই সাতটির পরিবর্তে শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সন প্রচলিত করার অধিকার খলিফা উসমান রাখেন কি-না? অনেকেই হয়তো বলবেন এটা সাহাবীদের ইজমা দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু যেটা স্বয়ং আল্লহ্ ও নবী কর্তৃক অনুমোদিত সেটাকে সংকুচিত করে একটি হারফে কুরআন প্রচলিত করা কি আল্লাহ্দ্রোহীতা নয়?
৬. ❝নারীরা কি স্বল্পবুদ্ধির? তাদের অধিকাংশ কি জাহান্নামি?❞ এই টপিকে উল্লেখিত হাদিসের বক্তব্য এতোটাই স্পষ্ট যে এখানে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। কিন্তু লেখক যেভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন তা খুবই অযৌক্তিক মনে হয়েছে। হাদিসটির অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা হলো। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবীজি বলেন,❝ ...বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা বললেনঃ আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায়, হে আল্লাহ্র রসূল? তিনি বললেনঃ একজন মহিলার সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি সালাত ও সিয়াম হতে বিরত থাকে না? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি।
(বুখারী ৩০৪, ১৪৬২, ১৯৫১, ২৬৫৮; মুসলিম ১/৩৪, হাঃ ৭৯, ৮০ আহমাদ ৫৪৪৩) (আ.প্র. ২৯৩, ই.ফা. ২৯৮)
৭. দাসপ্রথা নিয়ে অনেককিছু বলা যায়। সংক্ষিপ্ত করার অভিপ্রায়ে এখানে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করবো না। তর্কসাপেক্ষে যদি তৎকালীন যুগের বিবেচনায় মেনেও নিই দাসপ্রথাকে কিন্তু বর্তমানে কি তা মানা সম্ভব? যদি বলা হয় ইসলামি এই বিধানকে তৎকালীন পরিবেশ বিবেচনায় মেনে নিতে হবে তাহলে এটাও বলা যায় যে, কুরআনের বিধানাবলিও সেই যুগের জন্যই প্রযোজ্য, বর্তমানের জন্য নয়।
৮. ❝উৎসর্গের উৎসবে❞ লেখক ঈদুল আযহায় পশুহত্যার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কুরবানির মাংস যেহেতু খাওয়া হয় এবং গরীবদের মাঝে দান করা হয় কাজেই এই পশুহত্যা অপরাধ নয় বা অনৈতিক নয়। লেখক এখানে কুরবানিকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে প্রাইমারি উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুরবানির প্রাইমারি উদ্দেশ্য কিন্তু মাংস ভক্ষণ নয় বরং আল্লাহ্র আদেশে পশু জবাই করা। আর এখানেই মূলত আপত্তি। আল্লাহ্ কেন বান্দার তাকওয়া পরীক্ষা করতে পশুহত্যা করতে আদেশ দিলেন তা বোধগম্য নয়।
৯. ❝তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র❞ আর্টিকেলে লেখক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূল টেক্সট বা বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গান চলে গিয়েছেন। প্রথমে আয়াতের অংশটি দেখে নিই। ❝তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।❞ আচ্ছা আয়াতটি পড়ে কি আপনার কখনো মনে হচ্ছে শস্যক্ষেতে যেমন বীজ থেকে নতুন শস্য উৎপন্ন হয় ঠিক সেরকমই নারীর দেহকে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে আয়াতটিতে শস্যক্ষেত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। না-কি এখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে নিজের ইচ্ছামত শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবে সেই বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই আয়াতটিতে স্ত্রী উপর পুরুষের ইচ্ছাকৃত যৌনমিলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লেখক পুরো আর্টিকেল জুড়ে নারীকে সন্তান উৎপাদনের শস্যক্ষেত্র হিসেব উল্লেখ করেছেন এবং সেইমত ব্যাখ্যা করেছেন। এবং ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মতো শুক্রানুর সাথে ডিম্বাণুর নিষেক ও নারীর গর্ভাশয়ে কীভাবে সন্তান বৃদ্ধি লাভ করে তার প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং মাটিতে বীজ থেকে কীভাবে চারার অঙ্কুরোদগমন হয় ও বৃদ্ধি পায় তারও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। পড়তে গিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি যদিও আমি বিজ্ঞানেরই ছাত্র।
আরও বিভিন্ন টপিকে আপত্তি আছে। যেমন, ❝ভিন্ন কিরাআতে ভিন্ন কথা❞, ❝স্রষ্টার প্রজ্ঞার অনন্য এক নিদর্শন - নাসখ❞, ❝অলৌকিক কিছু ঘটলে❞, ❝হিজড়াদের হত্যা করা❞, ❝একটি প্রশ্ন, একটি উত্তর❞ ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে আর কিছু লিখছি না। আলোচনা এমনিতেই বড়ো হয়ে গিয়েছে।
বর্তমানে এধরনের অসংখ্য বই লেখা হচ্ছে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখি। কারণ ধর্ম ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আপত্তির জায়গাগুলো কি মানুষ তা জানতে পারছে এবং তার জবাবগুলোর মাধ্যমে সেই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ও চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত হচ্ছে।
প্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশন
এই আলোচনাটি মূলত বইটিতে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের বিপরীতে আমার নিজস্ব মতামত। ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক লেখকের অনেকগুলো লেখা এখানে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে অল্প কিছু টপিকের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেলেও অধিকাংশ বিষয়ের ব্যাখ্যা আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সেই আপত্তির জায়গা থেকেই কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই আলোচনা।
১. বইটি শুরুই হয়েছে বিজ্ঞানের কথিত কিছু বিশ্বাস নিয়ে। আমরা জানি ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। কিন্তু লেখক বলেছেন বিজ্ঞানও কিছু কিছু বিষয় ধরে নেয় বা বিশ্বাস করে নেয়। প্রথমেই তিনি বলেছেন, ❝বিজ্ঞানের বিশ্বাসগুলোর মাঝে অন্যতম একটি বিশ্বাস হল - আমাদের ইন্দ্রিয় ও চিন্তাজগতের বাইরে এই বিশ্বজগতের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে।❞ লেখক যেটা বুঝাতে চেয়েছেন তা একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝালে বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন, আপনি বা আমি প্রতিনিয়ত সূর্য দেখি যা পূর্ব দিক থেকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে, আপনি প্রতিদিন যে সূর্য দেখছেন তা আসলেই অস্তিত্বশীল না-কি সেটা একটা মরিচীকা মাত্র। মানে আপনি আমি বা পৃথিবীর সবাই যে সূর্য দেখছি তা যে আসলেই সূর্য তা বলা যাবে না। বরং এটা আমাদের দৃষ্টির ভ্রান্তিও হতে পারে। বিজ্ঞানের দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ভাবজগতে চলে গিয়েছেন বাস্তবকে অস্বীকার করে। যেমন কেউ কেউ বলে থাকেন, পুরো মহাবিশ্বই হলো একটা মায়ার জগৎ। সেই মায়ার জালে আমরা সকলেই আচ্ছন্ন!
দ্বিতীয় পয়েন্টে লেখক বলেছেন, ❝আমরা যে যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব এটাও কিন্তু বিজ্ঞানের অনুমান।❞ লেখক কি বলতে চেয়েছেন, আমরা কোনো কিছু যৌক্তিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম নই? কিন্তু বিজ্ঞান জোর করে আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতে বলছে! এই পয়েন্টটিতে লেখকের স্ববিরোধীতাও ফুটে উঠেছে। লেখক ইসলামের পক্ষে নিজেই বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করছেন আবার নিজেই বলছেন তিনি যৌক্তিক চিন্তাক্ষমতা সম্পন্ন জীব নন।
চতুর্থ পয়েন্টে লেখক বলেছেন, বিজ্ঞান সকল প্রাকৃতিক ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা করে। কোনো অপ্রাকৃত বিষয়ের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে নেই। যা বাস্তবিক তাই নিয়েই বিজ্ঞানের কাজ এবং আলোচনা। এবং এই জাগতিক বিশ্লেষণ ও তার প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন সুফল পাচ্ছি। অপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণের আগে তার তো অস্তিত্ব থাকা চাই। কিন্তু অস্তিত্ব কোথায়? লেখক কীভাবে নিশ্চিত হলেন বা তার প্রমাণই বা কোথায়?
২. পরবর্তী দু'টি টপিকে একজন স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা ও তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। স্রষ্টা থাকাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি আছে স্রষ্টার নামে প্রচলিত ধর্মগুলো নিয়ে। একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও ইসলাম বা অন্যান্য ধর্ম সেই স্রষ্টা প্রবর্তিত কি-না তা সহজেই যাচাই করা যায় সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো দিয়ে। এবং সেই গ্রন্থগুলোতে প্রশ্ন তোলার মতো অনেক বিষয়ই বিদ্যমান। এই আর্টকেলটি আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছে। কারণ আপত্তি তোলা হয় ইসলাম যাকে সৃষ্টিকর্তা বলে সেই আল্লাহ্কে নিয়ে কোনো পরম সৃষ্টিকর্তা নিয়ে নয়।
৩. ❝হিউম্যান : মানব না দানব?❞ আর্টিকেলে লেখক বলেছেন, পশ্চিমা বিভিন্ন ভাবধারা (স্বাধীনতা-সমতা-নৈতিকতা-নিরপেক্ষতা-প্রকৃতিবাদ এসব চিন্তাদর্শন) আমাদের মগজে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। যেমন কেন মেয়েরা অর্ধেক সম্পত্তি পেল? কেন মেয়েদের সাক্ষীর দাম ছেলেদের অর্ধেক? কেন আল্লাহ যুদ্ধ করতে বললেন? কেন চার বিয়ের অনুমতি? কেন দাসদাসীর বিধান?
পশ্চিমা ওই মতবাদগুলো কেন নিন্দনীয় বা অযৌক্তিক এবং ইসলামের উল্লেখিত বিধানগুলো কেন মহৎ এবং প্রশংসনীয় তার কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ লেখক করেননি। শুধু বলেছেন ইউরোপীয় ঐসব ভাবধারা মাথা থেকে বের করে ইসলামের একনিষ্ঠ আনুগত্যেই আছে মুক্তির পথ।
৪. ❝নারী-স্বাধীনতা নাকি দাসত্ব?❞ আর্টিকেলে লেখক একজন নারীকে জোরপূর্বক পুরুষের সমান হওয়ার যে প্রতিযোগীতা তার সমালোচনা করেছেন। পুরুষকে আইডল হিসেবে ধরে তার অনুসরণ ও অনুকরণ করার বিরোধিতা করেছেন। আমার মতে লেখক গোড়াতেই ভুল করেছেন সংজ্ঞাতে। কারণ নারী অধিকার বা নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে নারীকে কখনোই পুরুষের অনুরূপ হওয়ার দাবি করা হয় না। বরং একজন মানুষ হিসেবে একজন নারীর যে অধিকার, পুরুষের মতো স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই নারী অধিকারের মূলমন্ত্র। এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামে কি নারী নিজের মত প্রকাশের অধিকার রাখে? একজন নারীর কাছে বিয়ের আগে পিতার এবং বিয়ের পরে স্বামীর নিঃশর্ত আনুগত্যই দাবি করে ইসলাম। নারী ও পুরুষের শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নারীকে যদি শুধু সন্তান জন্মদান ও স্বামীর সম্ভোগের মাধ্যম হিসেবে দেখি এবং ঘরের চারদেয়ালে বন্দি করে রাখি সেখানেই আপত্তির জায়গা।
৫. কুরআনের প্রাচীন পান্ডুলিপি ও আহরুফ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমে ভাষা নিয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমত, পৃথিবীর কোনো ভাষাই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। একভাষায় প্রকাশিত মনের ভাব অন্য ভাষায় পরিপূর্ণভাবে অনুবাদ বা রুপান্তর করা সম্ভব নয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার বাণী বা আদেশ সেই সীমাবদ্ধ একটি মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। আমরা যারা অনারব তারা বলতেই পারি সৃষ্টিকর্মে আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন।
দ্বিতীয়ত, ভাষার আরও একটি সমস্যা হলো তার আঞ্চলিকতা। বর্তমানে প্রত্যেক ভাষারই একটি ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন আছে। বাংলায় যেমন আছে প্রমিত বাংলা। অতীতে কিন্তু এমন কোনো ইস্ট্যান্ডার্ড ভার্সন ছিলোনা। এবং এই সীমাবদ্ধতা স্বয়ং ঈশ্বরও এড়াতে পারেননি। তাই কুরআানকেও সাতটি আরবি হারফ (বহুবচনে আহরুফ) বা উপভাষায় নাজিল করতে হয়েছে। কুরআন সংকলের সময় খলিফা উসমান শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সনটি রেখে বাকীগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেন। ফলে পরবর্তীতে কুরআনের এই ভার্সনটিই প্রচলিত হয়। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, যেই সাত আরবি হারফে স্বয়ং স্রষ্টা কুরআন নাজিল করলেন এবং নবীজি নিজে তা সাহাবীদের শিক্ষা দিয়ে গেলেন সেই সাতটির পরিবর্তে শুধুমাত্র কুরায়শি ভার্সন প্রচলিত করার অধিকার খলিফা উসমান রাখেন কি-না? অনেকেই হয়তো বলবেন এটা সাহাবীদের ইজমা দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু যেটা স্বয়ং আল্লহ্ ও নবী কর্তৃক অনুমোদিত সেটাকে সংকুচিত করে একটি হারফে কুরআন প্রচলিত করা কি আল্লাহ্দ্রোহীতা নয়?
৬. ❝নারীরা কি স্বল্পবুদ্ধির? তাদের অধিকাংশ কি জাহান্নামি?❞ এই টপিকে উল্লেখিত হাদিসের বক্তব্য এতোটাই স্পষ্ট যে এখানে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। কিন্তু লেখক যেভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটিকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন তা খুবই অযৌক্তিক মনে হয়েছে। হাদিসটির অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা হলো। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবীজি বলেন,❝ ...বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা বললেনঃ আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায়, হে আল্লাহ্র রসূল? তিনি বললেনঃ একজন মহিলার সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি সালাত ও সিয়াম হতে বিরত থাকে না? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি।
(বুখারী ৩০৪, ১৪৬২, ১৯৫১, ২৬৫৮; মুসলিম ১/৩৪, হাঃ ৭৯, ৮০ আহমাদ ৫৪৪৩) (আ.প্র. ২৯৩, ই.ফা. ২৯৮)
৭. দাসপ্রথা নিয়ে অনেককিছু বলা যায়। সংক্ষিপ্ত করার অভিপ্রায়ে এখানে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করবো না। তর্কসাপেক্ষে যদি তৎকালীন যুগের বিবেচনায় মেনেও নিই দাসপ্রথাকে কিন্তু বর্তমানে কি তা মানা সম্ভব? যদি বলা হয় ইসলামি এই বিধানকে তৎকালীন পরিবেশ বিবেচনায় মেনে নিতে হবে তাহলে এটাও বলা যায় যে, কুরআনের বিধানাবলিও সেই যুগের জন্যই প্রযোজ্য, বর্তমানের জন্য নয়।
৮. ❝উৎসর্গের উৎসবে❞ লেখক ঈদুল আযহায় পশুহত্যার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কুরবানির মাংস যেহেতু খাওয়া হয় এবং গরীবদের মাঝে দান করা হয় কাজেই এই পশুহত্যা অপরাধ নয় বা অনৈতিক নয়। লেখক এখানে কুরবানিকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে প্রাইমারি উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুরবানির প্রাইমারি উদ্দেশ্য কিন্তু মাংস ভক্ষণ নয় বরং আল্লাহ্র আদেশে পশু জবাই করা। আর এখানেই মূলত আপত্তি। আল্লাহ্ কেন বান্দার তাকওয়া পরীক্ষা করতে পশুহত্যা করতে আদেশ দিলেন তা বোধগম্য নয়।
৯. ❝তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র❞ আর্টিকেলে লেখক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূল টেক্সট বা বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গান চলে গিয়েছেন। প্রথমে আয়াতের অংশটি দেখে নিই। ❝তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।❞ আচ্ছা আয়াতটি পড়ে কি আপনার কখনো মনে হচ্ছে শস্যক্ষেতে যেমন বীজ থেকে নতুন শস্য উৎপন্ন হয় ঠিক সেরকমই নারীর দেহকে সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে আয়াতটিতে শস্যক্ষেত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। না-কি এখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে নিজের ইচ্ছামত শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবে সেই বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই আয়াতটিতে স্ত্রী উপর পুরুষের ইচ্ছাকৃত যৌনমিলনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লেখক পুরো আর্টিকেল জুড়ে নারীকে সন্তান উৎপাদনের শস্যক্ষেত্র হিসেব উল্লেখ করেছেন এবং সেইমত ব্যাখ্যা করেছেন। এবং ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মতো শুক্রানুর সাথে ডিম্বাণুর নিষেক ও নারীর গর্ভাশয়ে কীভাবে সন্তান বৃদ্ধি লাভ করে তার প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং মাটিতে বীজ থেকে কীভাবে চারার অঙ্কুরোদগমন হয় ও বৃদ্ধি পায় তারও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। পড়তে গিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি যদিও আমি বিজ্ঞানেরই ছাত্র।
আরও বিভিন্ন টপিকে আপত্তি আছে। যেমন, ❝ভিন্ন কিরাআতে ভিন্ন কথা❞, ❝স্রষ্টার প্রজ্ঞার অনন্য এক নিদর্শন - নাসখ❞, ❝অলৌকিক কিছু ঘটলে❞, ❝হিজড়াদের হত্যা করা❞, ❝একটি প্রশ্ন, একটি উত্তর❞ ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে আর কিছু লিখছি না। আলোচনা এমনিতেই বড়ো হয়ে গিয়েছে।
বর্তমানে এধরনের অসংখ্য বই লেখা হচ্ছে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখি। কারণ ধর্ম ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আপত্তির জায়গাগুলো কি মানুষ তা জানতে পারছে এবং তার জবাবগুলোর মাধ্যমে সেই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ও চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত হচ্ছে।